মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

আরশিনগরের পড়শি ।। কালের লিখন

আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর,
সেথায় এক পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গেরাম বেড়ে অগাধপানি,
নাই কিনারা নাই তরণি, পারে,
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে,
আমি কেমনে সেথা যাইরে।
বলব কী সে পড়শির কথা,
তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা, নাইরে,
ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
পড়শি যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেত দূরে,
সে আর লালন একখানে রয়,
তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে।
আলোচ্য বানীর রুপক শব্দের শব্দার্থ বিন্যাস

আরশিনগর, পড়শি, গেরাম, অগাধপানি, লক্ষযোজন, নীর ।
আরশিনগর»  আয়নামহল, দর্পণগৃহ, গুপ্তগৃহ, কাঁচেরঘর, গোপনঘর, আয়না বা আরশি ছাড়াই নিজকে নিজে দেখা যায় এরূপ নগর। জঠরে সাঁইরূপ তরলমানুষ অবতারিত হলে সাধকগণ সাধনবলে তার সাক্ষাৎলাভ করতে পারেন বলে জঠরকে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা আরশিনগর বলে থাকেন। দেহতত্ত্বে স্ত্রী জননতন্ত্রের সন্তান ধারণ ও লালনকারী অংশকে গর্ভাশয় বা রুপকের আচ্ছাদনে আরশিনগর বলা হয়। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  কাশী, ঢাকা, নিধুয়া, মথুরা, হ্যাভেন, জান্নাত, আরশ, মদিনা, আকাশ, পাতাল, স্বর্গ, নিধুয়া প্রভৃতি।
(বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে- লালিত লালন)
পড়শি» প্রতিবেশী, প্রতিবাসী, বাড়ির কাছেই যার বাস। দেহরূপ বাড়ির খুব সন্নিকটে মানবের তরলরূপ সাঁই অবতরণ করেন বলে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা সাঁইকে পড়শি বলে থাকেন। মাতৃজঠরে জীবের ভ্রণ লালন-পালনকারী সুমিষ্ট সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রুপকের আচ্ছাদনে  পড়শি বলা হয়। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, গার্ডিয়ান, রব, উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ, উপাস্য, পালক, সাঁই প্রভৃতি।
(পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে, সে আর লালন একখানে রয়,তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে – লালিত লালন।)
গেরাম»  গ্রাম, গাঁ, পল্লি, পাড়াগাঁ, দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, জাসাদ। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে দেহ বা রুপকের আচ্ছাদনে  গেরাম বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো- কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা প্রভৃতি।
(গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, নাই কিনারা, নাই তরণি পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখবো তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে- লালিত লালন)
অগাধপানি » অথৈজল, গভীরজল, গভীরজ্ঞান, সূক্ষ্মজ্ঞান, দিব্যজ্ঞান, আধ্যজ্ঞান, আধ্যাত্মিকজ্ঞান
(গেরাম বেড়ে অগাধপানি, নাই কিনারা নাই তরণি পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে- লালিত লালন)
লক্ষযোজন» অনেক যোজন, অনেক ব্যবধান, আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা মূলককে আচ্ছাদিত করার প্রয়াসে রুপকে নতুন শব্দ নির্মাণ করেন, তাঁরা অনেক সময় এক কে একলক্ষ বা চার কে চারলক্ষ বলে থাকেন, রুপক সাহিত্যে মূলকের পরবর্তী শূন্যের বিশেষ কোন মুল্য নেই। সেজন্য ১,০০,০০০ হতে দু’টি শূন্য বাদ দিলে ১,০০০ অবশিষ্ট থাকে। ফলে লক্ষযোজন সমান হাজার বছর বা হাজার শ্বাস বলা হয়ে থাকে।
নীর» জল, বারি, সলিল, রস,  নৈর। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা মাতৃজঠরে জীবের ভ্রণ লালন-পালনকারী সুমিষ্ট সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রুপকের আচ্ছাদনে নীর বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ  হলো-  পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, গার্ডিয়ান, রব, উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ, উপাস্য, পালক, সাঁই প্রভৃতি।
(কী বলব সে পড়শির কথা, তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে, সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর, সে ক্ষণেক ভাসে নীরে- লালিত লালন)
আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আত্মতত্ত্ব দেহতত্ত্বের প্রাণপুরুষ, সাধককুল শিরোমণি বাঙালি ভাষাভাষীদের জন্য মহান রূপকার, বাংলাভাষার মরমিকবি, আত্মতত্ত্বের জনক মহাত্না লালন সাঁইজি। মহান আধ্যাতিক জ্ঞানতাপস ও জীবন ঘনিষ্ঠ আত্মতাত্ত্বিক দার্শনিক মহাত্না লালন সাঁইজি একজন সুমহান রূপকার হিসেবে রুপকের অন্তরালে আত্মতত্ত্বের কথা বলে গেছেন তাঁর নির্মিত সকল বাণীতে, সাঁইজির বাণীর মূল শিক্ষা হলো- মানব জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য নিজেকে জানা অতি জরুরী, মানুষতত্ত্ব- শ্রেষ্ঠতত্ত্ব, ভাব নয় বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে মূলে ধাবিত করে। সাঁইজির প্রতিটি সহজ পদ আত্মদর্শনের অমিয় বাণী, এর তাল, লয়, ছন্দ, ভাব, ভাষা, শব্দের গাঁথুনি, উপমাশৈলী আর রুপকের অন্তরালে মূলকের আভাস, মোহিত করে অনুসন্ধিৎসু মন।
মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহ্বান জানানো হয়েছে।
আলোচ্য বানীতে সাঁইজি বাড়ির পাশেই একটা আরশিনগরে তাঁর পড়শির সন্ধান করেছেন। বাড়ির পাশেই তার বসবাস, অথচ সেই পড়শিকে একদিনের জন্যও দেখতে না পাওয়ার বেদনা, কৌতূহল আর আকাংখা ফুটে উঠেছে আলোচ্য বাণীটিতে।
সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।
আত্মতত্ত্বের আলোকে যদি আমরা বানীটির স্বরূপ উদঘাটন করতে যাই দেখবো সাঁইজি তাঁর পড়শিরূপ মনের মানুষ সাঁইয়ের সন্ধান করছেন আরশিনগর রূপ মাতৃজঠরে। দেহরূপ বাড়ীর ভিতরে জঠররূপ আরশিনগর বা বারামখানায় পড়শির বসবাস। একই অঞ্চলে বসবাস অথচ একদিনও পড়শির দেখা নেই, তাই সাঁইজি বলছেন- আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গেরামের অন্তরালে দেহনামক নগরীর আনাচে কানাচে অগাধপানির মতো দিব্যজ্ঞানের ছড়াছড়ি, যার কোন কূল- কিনারা নাই, নাই সেই আধ্যজ্ঞান রূপ দেহ সায়র পাড়ি দেবার কোন তরণিও, এই দেহনামক নগরের কোন জায়গায় পড়শির অবস্থান, কিভাবে তার কাছে গিয়ে মনের বাঞ্ছা বা আশা পূরণ করবো এই ভাবনায় ব্যাকুল পড়শি প্রেমি সাইজি। সাঁইজি বলছেন-গেরাম বেড়ে অগাধপানি, নাই কিনারা নাই তরণি, পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে।
এতক্ষনে সাঁইজি তাঁর পড়শির বর্ণনা দিচ্ছেন, কি বলবো সেই সাঁইরূপ পড়শির কথা, মাসান্তে একবার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথাহীন তরলমানুষ নিত্যধামে অবস্থান করেন, শুন্যে অর্থাৎ ব্রহ্মতালুতে মস্তিস্ক মেরুজল উৎপত্তি হয়ে তা বৈয়াম্বুযোগে মূলাধার চক্র ঘুরে গর্ভাশয়ে নীরের মতো মীন রুপে ভাসতে থাকেন, সাঁইজির প্রানের পড়শি, মানুষের তরল বা সাকার রূপ, মানবের উপাস্য স্বয়ং সাঁই। সাঁইজি বলছেন- বলব কী সে পড়শির কথা, তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা, নাইরে, ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
চাতক বা শুদ্ধ সাধকের ন্যায় সাঁইজির প্রার্থনাময় আকুলতা- যদি একবার নিজের স্বরূপ দর্শন হতো, পড়শির সন্ধান পেতাম, একবার ছুঁতে পারলে সেই অধর চাঁদকে, মানবকর্ম সারা হতো, ভবের যম যাতনা সকল দূরে চলে যেতো, অমৃতজল রূপ সাঁইকে আহরণ করে জন্ম মৃত্যু রহিত করে ঘটতো আত্মমুক্তি, প্রতিষ্ঠা পেতো আত্মার অখণ্ডতা।  জনমভর পড়শি আমার বাড়ির আঙিনাতেই থাকে, একইখানে বসবাস ব্যাক্তি লালন সাঁইজি আর তাঁর পড়শি জগতের পালনকর্তা লালনের, এ উভয় লালন একদেহে অবস্থান করলেও ব্যক্তি লালন উপাস্য লালনের সাথে সাক্ষাতলাভ করতে প্রায় একহাজার শ্বাস সময়ের প্রয়োজন হয়। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা এই একহাজার শ্বাসকে হাজার মাস, হাজার বছর, হাজার যোজন বলে থাকেন। হাজার যোজনকে আবার লক্ষযোজন, লক্ষবছর, লক্ষভুবন, লক্ষযোনি ইত্যাদি বলা হয়।
সোনারতরী কাব্যে যেমন রবি ঠাকুর বললেন- এতকাল নদীকূলে, যাহা লয়ে ছিনু ভুলে, সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে, এখন আমারে লহ করুণা করে। তদ্রুপ সমর্পিত আকুলতা, আকাংখা আর প্রেম দেখতে পাই সাঁইজি যখন বলেন-  পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে, সে আর লালন একখানে রয়, তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে।
আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, সাঁইজি বারবার তাঁর বানীতে মনেরমানুষ, অধরমানুষ, প্রেমেরমানুষ, ভাবেরমানুষ তথা পড়শি রূপ তরল মানুষের কথা বলে গেছেন, পৃথিবীর সুপ্রাচীন আত্মতত্ব, দেহতত্ত্ব, আর আত্মদর্শনের সার্বিক পরম্পরাজ্ঞান, সাঁইজি একজন সার্থক রুপকার হিসেবে তাঁর বানীতে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুন মুন্সিয়ানায়।
বাংলা ভাষাভাষীর জন্য সাঁইজির নির্মাণ এক অনুপম আশীর্বাদ। তাই আরশিনগরের পড়শির সন্ধান পেতে, গুরুর পাঠশালায় ভর্তি হয়ে, দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করতে হবে সবার আগে। নচেৎ লালন বানী পড়শির মতোই অধরা থেকে যাবে জনমভর। আরশি নগরের পড়শির সার্বিক তথ্য, যোগাযোগের ঠিকানা আর কোন দিন কোন সময় পড়শির সাথে দেখা হয়, এসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ তত্ত্বের গভীর হতে গভীরতম আলোচনা, ব্যাখ্যা, আর আত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রত্যেকের নিজ নিজ জ্ঞানগুরুর কাছ থেকেই জেনে বুঝে নেয়া উচিৎ। অথবা  একজন আত্মতাত্ত্বিক দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন  পাকা সাধকগুরুর সান্নিধ্য নিয়েই সকল মানুষের আত্মদর্শনের জ্ঞান আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।

তথ্যসুত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন»
  সম্পাদনা»  গবেষণা» 
 কালের লিখন

1 টি মন্তব্য: