মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

পাখি কখন জানি উড়ে যায় ।। কালের লিখন

একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়
পাখি কখন জানি উড়ে যায়।
খাঁচার আড়া পড়লে ধ্বসে, 
পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, 
সেই ভাবনা ভাবছি বসে, 
সদা চমকজ্বরা বইছে গায়। 
কারবা খাঁচায় কেবা পাখি, 
কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, 
পাখি আমারি  আঙিনায় থাকি, 
আমারে মজাতে চায়। 
সুখের পাখি যাবে উড়ে, 
খালি খাঁচা রবে পড়ে, 
সঙ্গের সাথী কেউ না রবে, 
লালন ফকির কেঁদে কয়।
আলোচ্য বানীর রুপক শব্দের শব্দার্থ বিন্যাস

খাঁচাপাখিআঙিনাচমকজ্বরাআড়া। 

খাঁচা» পিঁজরা, পিঞ্জর, পিঞ্জিরা, টক্সগ, টোপা, অস্থিপঞ্জর, কাঠামো, খাদ্যদ্রব্য ঢেকে রাখার খোপ খোপ ঢাকনি। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে দেহ বা রুপকের আচ্ছাদনে  খাঁচা  বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো- কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা প্রভৃতি। (খাঁচার আড়া পড়ল ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
পাখি»পক্ষী, বিহগ, বিহঙ্গ, জৈব্যতা, জীবনিশক্তি, ব্রহ্মশক্তি, সঞ্জীবনী, যে শক্তির বলে বীজ অংকুরিত হয়, বায়োগ্র্যাফি, স্বায়ম্ভু, স্বয়ংসৃষ্ট, স্বয়ং অস্তিত্বশীল, জৈব্যতা। প্রাণিদেহে ব্যাপৃত চৈতন্যময়সত্তা। আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা জীবকোষকে জীবাত্মার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সূক্ষ্মশক্তিকে জৈব্যতা বা রূপকার্থে পাখি বলে থাকেন। (একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়পাখি কখন জানি  উড়ে যায়। – লালিত লালন)
আঙিনা»  আঙ্গিনা, অঙ্গন, উঠান, প্রাঙ্গণ, কোল, ক্রোড়, বুক, কাঁখ। আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা ভগ হতে ভৃগু পর্যন্ত স্ত্রী জননপথকে বৈতরণী, কানাই বা রুপকের আচ্ছাদনে আঙিনা বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  বৈতরণী, গয়া, গণ্ডকী, ফল্গু, বিরজা, মন্দাকিনী, যমুনা, সুরধুনী, সুরনদী, সুড়ংগ জননপথ, মর্ত্যধাম হতে স্বর্গধামে গমনের একমাত্র নদী, ভেজাইনা, উঠান, ডাংগা, দুয়ার, নদী, খাল, নালা, ক্যানাল, বরজখ, বিরজা। (কার বা খাঁচায় কে বা পাখি, কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, পাখি আমারি আঙিনায় থাকি, আমারে মজাতে চায়- লালিত লালন)
চমকজ্বরা»(চমক+জ্বরা) অত্যন্ত আতংকিত ভাব, ভীষণ বিস্ময়ভাব, অত্যন্ত ভীত ও আতংকিত হওয়ার ফলে শরীরে উৎপন্ন তাপ, হঠাৎ বিস্ময় হওয়ার কারণে এবং অতিরিক্ত হৃদকম্পনের ফলে শরীরে উৎপন্ন তাপ (খাঁচার আড়া পড়লে  ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
আড়া» আকৃতি, গঠন, ডৌল, প্রকার, রকম, ধরন। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে কায়া বা রুপকের আচ্ছাদনে আড়া বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, উষ্ট্র, গাছ, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি।
(খাঁচার আড়া পড়ল ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, সাঁইদর্শন, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহব্বান জানানো হয়েছে।
সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।
আলোচ্য বানীতে সাঁইজি আত্মারূপ পাখির উড়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। কখন কোন বিমার বা বদ হাওয়ায় দেহরূপ খাঁচা ছেড়ে আত্মারূপ পাখি উড়াল দেয়। তাই সাঁইজি উদাসনেত্র মেলে তাকিয়ে থাকেন অনাগত দিনে আর গেয়ে উঠেন- একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়, পাখি কখন জানি উড়ে যায়।
বিমূর্তশক্তিই ধীরে ধীরে মূর্তমান হয়ে উঠে। শক্তির মূর্তমান এ রূপটিকেই বলে আকার, দেহ, কাঠামো বা খাঁচা। আগুন, জল, মাটি, বাতাস ও বিদ্যুৎ- এ পাঁচ উপাদানে জীবদেহ সৃষ্টি। দেহতাত্ত্বিকরা এই পাঁচ উপাদানকে একত্রে আদি পঞ্চভূত বলে থাকেন। দেহকে জীবিত বা প্রাণবন্ত রাখতে প্রয়োজন হয় প্রাণশক্তি বা আত্মা। তাই বলা যায় দেহ হলো আত্মারই মূর্তমান রূপ। আত্মা বিমূর্ত কিন্তু দেহ মূর্ত। বিমূর্তশক্তি হতে সৃষ্টি হয় মূর্তমান দেহ। আত্মা ছাড়া কোন দেহই কল্পনা করা যায় না। অপরদিকে খাঁচা বা দেহ ছাড়া আত্মার আশ্রয় অসম্ভব, তাই সাঁইজি বলছেন- খাঁচা যদি ভেঙ্গে যায়, যদি আদি পঞ্চভূতের সুষম সমন্বয় না হয় বিদ্যুৎ শক্তি রূপ আত্মা বা পাখি এসে দাঁড়াবে কোথায়? সাঁইজি ভাবছেন দেহযন্ত্র বিকল হলে সকল বৃথা, পাখি ফাঁকি দিবে, অত্যন্ত ভীত ও আতংকিত দেহ-চিত্তে সাঁইজি বলছেন- খাঁচার আড়া পড়লে ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, সেই ভাবনা ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়।
যখন দেহরূপ খাঁচা ছেড়ে একবার পাখি উড়ে যাবে তা আর পুনঃস্থাপিত হবেনা, একে অপরের কাছে অচেনা হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। কারো জন্য কারো ভাবনা নেই, নেই আঁখির জল। কোন কূল কিনারা থাকবেনা, কার খাঁচা আর কে পাখি। একদিকে দেহ পড়ে আছে নিথর, নিশ্চল, অন্যদিকে উড়ে গেছে দেহের পাঁচ উপাদানের একটি উপাদান বিদ্যুৎ শক্তি বা আত্মা, তাই সাঁইজি বলছেন-  কারবা খাঁচায় কেবা পাখি, কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, পাখি আমারি আঙিনায় থাকি, আমারে মজাতে চায়।
বিদ্যুৎ এক প্রকার শক্তি। এ শক্তি ছাড়া প্রাণীকূল ও উদ্ভিদকূল এক মুহূর্তের জন্যও বাঁচতে পারেনা, তাই এই তড়িৎ বা বিদ্যুৎ শক্তিকেই জীবের প্রকৃত জীবাত্মা বলা হয়। হৃদপিণ্ডের মাধ্যমে দেহে যখন রক্ত সঞ্চালিত হয়। তখন রক্ত কণিকার ঘর্ষণে এ বিদ্যুৎশক্তিটি জীবদেহে উৎপন্ন হয়। এ শক্তিটি জীবদেহে বিদ্যমান থাকাকে জীবের জীবিত থাকা বলা হয়। এ শক্তিটি দেহ হতে বিলুপ্ত হওয়াকে জীবের প্রয়াণ বলা হয়। কোন কারণে হৃদযন্ত্রটি বিকল হয়ে গেলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন বন্ধ হয়ে যায় এবং জীব প্রয়াণলাভ করে। একবার বিদ্যুৎ শক্তিরূপ আত্মা বা সুখের পাখি দেহ ছেড়ে গেলে শুধু খালি খাঁচা পড়ে থাকে যাকে আমরা মড়ক বলি, আত্মা, মন আর জ্ঞানহীন খালি খাঁচা বা দেহের কোন সঙ্গী সাথী নেই, তাই মহাত্মা লালন ফকির কেঁদে বলছেন- সুখের পাখি যাবে উড়ে, খালি খাঁচা রবে পড়ে, সঙ্গের সাথী কেউ না রবে, লালন ফকির কেঁদে কয়।
আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, সাঁইজি বারবার তাঁর বানীতে দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব আর আত্মদর্শনের কথা বলে গেছেন। পৃথিবীর সুপ্রাচীন আত্মতত্ব, দেহতত্ত্ব, আর আত্মদর্শনের সার্বিক পরম্পরাজ্ঞান , সাঁইজি একজন সার্থক রুপকার হিসেবে তাঁর বানীতে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুন মুন্সিয়ানায়। বাংলা ভাষাভাষীর জন্য সাঁইজির নির্মাণ এক অনুপম আশীর্বাদ।
একজন মানুষের চারটি মূল সত্ত্বা- দেহ, আত্মা, মন আর জ্ঞান। একজন মানুষ যখন তার দেহের বিস্তারিত জানবে, পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গের ব্যাবহার বিধি জানবে, আত্মার প্রকারভেদ আর আত্মমুক্তির পথ জানবে, মনের প্রকারভেদ আর কার্যকরণ জানবে, সেই সাথে জানবে জ্ঞান বা মহাত্মার খুঁটিনাটি তখনি তার দিব্যজ্ঞান উদয় হবে।
আলোচ্য বাণীর আলোকে বলা যায়- আত্মার প্রকারভেদ, আত্মার অবস্থান, দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক, আত্মা অক্ষয়, অমর ও শ্বাশত নাকি ধ্বংসশীল? আত্মা ও দেহ কোনটি আগে সৃষ্টি, আত্মার মুক্তি রহস্য, প্রয়াণের পর আত্মার অবস্থানসহ আত্মার আত্মিক উন্নয়ন সাধনে সার্বিক তথ্য ও পরম্পরা জ্ঞান প্রত্যেকের নিজনিজ জ্ঞানগুরুর কাছ থেকে জেনে বুঝে নেয়া একান্ত কর্তব্য।
অথবা একজন আত্মতাত্ত্বিক দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন পাকা সাধকগুরুর সান্নিধ্য নিয়েই সকল মানুষের আত্মদর্শনের জ্ঞান আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।

তথ্যসুত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন»
  সম্পাদনা»  গবেষণা» 
 কালের লিখন

আরশিনগরের পড়শি ।। কালের লিখন

আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর,
সেথায় এক পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গেরাম বেড়ে অগাধপানি,
নাই কিনারা নাই তরণি, পারে,
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে,
আমি কেমনে সেথা যাইরে।
বলব কী সে পড়শির কথা,
তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা, নাইরে,
ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
পড়শি যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেত দূরে,
সে আর লালন একখানে রয়,
তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে।
আলোচ্য বানীর রুপক শব্দের শব্দার্থ বিন্যাস

আরশিনগর, পড়শি, গেরাম, অগাধপানি, লক্ষযোজন, নীর ।
আরশিনগর»  আয়নামহল, দর্পণগৃহ, গুপ্তগৃহ, কাঁচেরঘর, গোপনঘর, আয়না বা আরশি ছাড়াই নিজকে নিজে দেখা যায় এরূপ নগর। জঠরে সাঁইরূপ তরলমানুষ অবতারিত হলে সাধকগণ সাধনবলে তার সাক্ষাৎলাভ করতে পারেন বলে জঠরকে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা আরশিনগর বলে থাকেন। দেহতত্ত্বে স্ত্রী জননতন্ত্রের সন্তান ধারণ ও লালনকারী অংশকে গর্ভাশয় বা রুপকের আচ্ছাদনে আরশিনগর বলা হয়। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  কাশী, ঢাকা, নিধুয়া, মথুরা, হ্যাভেন, জান্নাত, আরশ, মদিনা, আকাশ, পাতাল, স্বর্গ, নিধুয়া প্রভৃতি।
(বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে- লালিত লালন)
পড়শি» প্রতিবেশী, প্রতিবাসী, বাড়ির কাছেই যার বাস। দেহরূপ বাড়ির খুব সন্নিকটে মানবের তরলরূপ সাঁই অবতরণ করেন বলে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা সাঁইকে পড়শি বলে থাকেন। মাতৃজঠরে জীবের ভ্রণ লালন-পালনকারী সুমিষ্ট সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রুপকের আচ্ছাদনে  পড়শি বলা হয়। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, গার্ডিয়ান, রব, উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ, উপাস্য, পালক, সাঁই প্রভৃতি।
(পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে, সে আর লালন একখানে রয়,তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে – লালিত লালন।)
গেরাম»  গ্রাম, গাঁ, পল্লি, পাড়াগাঁ, দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, জাসাদ। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে দেহ বা রুপকের আচ্ছাদনে  গেরাম বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো- কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা প্রভৃতি।
(গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, নাই কিনারা, নাই তরণি পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখবো তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে- লালিত লালন)
অগাধপানি » অথৈজল, গভীরজল, গভীরজ্ঞান, সূক্ষ্মজ্ঞান, দিব্যজ্ঞান, আধ্যজ্ঞান, আধ্যাত্মিকজ্ঞান
(গেরাম বেড়ে অগাধপানি, নাই কিনারা নাই তরণি পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে- লালিত লালন)
লক্ষযোজন» অনেক যোজন, অনেক ব্যবধান, আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা মূলককে আচ্ছাদিত করার প্রয়াসে রুপকে নতুন শব্দ নির্মাণ করেন, তাঁরা অনেক সময় এক কে একলক্ষ বা চার কে চারলক্ষ বলে থাকেন, রুপক সাহিত্যে মূলকের পরবর্তী শূন্যের বিশেষ কোন মুল্য নেই। সেজন্য ১,০০,০০০ হতে দু’টি শূন্য বাদ দিলে ১,০০০ অবশিষ্ট থাকে। ফলে লক্ষযোজন সমান হাজার বছর বা হাজার শ্বাস বলা হয়ে থাকে।
নীর» জল, বারি, সলিল, রস,  নৈর। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা মাতৃজঠরে জীবের ভ্রণ লালন-পালনকারী সুমিষ্ট সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রুপকের আচ্ছাদনে নীর বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ  হলো-  পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, গার্ডিয়ান, রব, উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ, উপাস্য, পালক, সাঁই প্রভৃতি।
(কী বলব সে পড়শির কথা, তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে, সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর, সে ক্ষণেক ভাসে নীরে- লালিত লালন)
আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আত্মতত্ত্ব দেহতত্ত্বের প্রাণপুরুষ, সাধককুল শিরোমণি বাঙালি ভাষাভাষীদের জন্য মহান রূপকার, বাংলাভাষার মরমিকবি, আত্মতত্ত্বের জনক মহাত্না লালন সাঁইজি। মহান আধ্যাতিক জ্ঞানতাপস ও জীবন ঘনিষ্ঠ আত্মতাত্ত্বিক দার্শনিক মহাত্না লালন সাঁইজি একজন সুমহান রূপকার হিসেবে রুপকের অন্তরালে আত্মতত্ত্বের কথা বলে গেছেন তাঁর নির্মিত সকল বাণীতে, সাঁইজির বাণীর মূল শিক্ষা হলো- মানব জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য নিজেকে জানা অতি জরুরী, মানুষতত্ত্ব- শ্রেষ্ঠতত্ত্ব, ভাব নয় বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে মূলে ধাবিত করে। সাঁইজির প্রতিটি সহজ পদ আত্মদর্শনের অমিয় বাণী, এর তাল, লয়, ছন্দ, ভাব, ভাষা, শব্দের গাঁথুনি, উপমাশৈলী আর রুপকের অন্তরালে মূলকের আভাস, মোহিত করে অনুসন্ধিৎসু মন।
মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহ্বান জানানো হয়েছে।
আলোচ্য বানীতে সাঁইজি বাড়ির পাশেই একটা আরশিনগরে তাঁর পড়শির সন্ধান করেছেন। বাড়ির পাশেই তার বসবাস, অথচ সেই পড়শিকে একদিনের জন্যও দেখতে না পাওয়ার বেদনা, কৌতূহল আর আকাংখা ফুটে উঠেছে আলোচ্য বাণীটিতে।
সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।
আত্মতত্ত্বের আলোকে যদি আমরা বানীটির স্বরূপ উদঘাটন করতে যাই দেখবো সাঁইজি তাঁর পড়শিরূপ মনের মানুষ সাঁইয়ের সন্ধান করছেন আরশিনগর রূপ মাতৃজঠরে। দেহরূপ বাড়ীর ভিতরে জঠররূপ আরশিনগর বা বারামখানায় পড়শির বসবাস। একই অঞ্চলে বসবাস অথচ একদিনও পড়শির দেখা নেই, তাই সাঁইজি বলছেন- আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গেরামের অন্তরালে দেহনামক নগরীর আনাচে কানাচে অগাধপানির মতো দিব্যজ্ঞানের ছড়াছড়ি, যার কোন কূল- কিনারা নাই, নাই সেই আধ্যজ্ঞান রূপ দেহ সায়র পাড়ি দেবার কোন তরণিও, এই দেহনামক নগরের কোন জায়গায় পড়শির অবস্থান, কিভাবে তার কাছে গিয়ে মনের বাঞ্ছা বা আশা পূরণ করবো এই ভাবনায় ব্যাকুল পড়শি প্রেমি সাইজি। সাঁইজি বলছেন-গেরাম বেড়ে অগাধপানি, নাই কিনারা নাই তরণি, পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে।
এতক্ষনে সাঁইজি তাঁর পড়শির বর্ণনা দিচ্ছেন, কি বলবো সেই সাঁইরূপ পড়শির কথা, মাসান্তে একবার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথাহীন তরলমানুষ নিত্যধামে অবস্থান করেন, শুন্যে অর্থাৎ ব্রহ্মতালুতে মস্তিস্ক মেরুজল উৎপত্তি হয়ে তা বৈয়াম্বুযোগে মূলাধার চক্র ঘুরে গর্ভাশয়ে নীরের মতো মীন রুপে ভাসতে থাকেন, সাঁইজির প্রানের পড়শি, মানুষের তরল বা সাকার রূপ, মানবের উপাস্য স্বয়ং সাঁই। সাঁইজি বলছেন- বলব কী সে পড়শির কথা, তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা, নাইরে, ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
চাতক বা শুদ্ধ সাধকের ন্যায় সাঁইজির প্রার্থনাময় আকুলতা- যদি একবার নিজের স্বরূপ দর্শন হতো, পড়শির সন্ধান পেতাম, একবার ছুঁতে পারলে সেই অধর চাঁদকে, মানবকর্ম সারা হতো, ভবের যম যাতনা সকল দূরে চলে যেতো, অমৃতজল রূপ সাঁইকে আহরণ করে জন্ম মৃত্যু রহিত করে ঘটতো আত্মমুক্তি, প্রতিষ্ঠা পেতো আত্মার অখণ্ডতা।  জনমভর পড়শি আমার বাড়ির আঙিনাতেই থাকে, একইখানে বসবাস ব্যাক্তি লালন সাঁইজি আর তাঁর পড়শি জগতের পালনকর্তা লালনের, এ উভয় লালন একদেহে অবস্থান করলেও ব্যক্তি লালন উপাস্য লালনের সাথে সাক্ষাতলাভ করতে প্রায় একহাজার শ্বাস সময়ের প্রয়োজন হয়। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা এই একহাজার শ্বাসকে হাজার মাস, হাজার বছর, হাজার যোজন বলে থাকেন। হাজার যোজনকে আবার লক্ষযোজন, লক্ষবছর, লক্ষভুবন, লক্ষযোনি ইত্যাদি বলা হয়।
সোনারতরী কাব্যে যেমন রবি ঠাকুর বললেন- এতকাল নদীকূলে, যাহা লয়ে ছিনু ভুলে, সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে, এখন আমারে লহ করুণা করে। তদ্রুপ সমর্পিত আকুলতা, আকাংখা আর প্রেম দেখতে পাই সাঁইজি যখন বলেন-  পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে, সে আর লালন একখানে রয়, তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে।
আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, সাঁইজি বারবার তাঁর বানীতে মনেরমানুষ, অধরমানুষ, প্রেমেরমানুষ, ভাবেরমানুষ তথা পড়শি রূপ তরল মানুষের কথা বলে গেছেন, পৃথিবীর সুপ্রাচীন আত্মতত্ব, দেহতত্ত্ব, আর আত্মদর্শনের সার্বিক পরম্পরাজ্ঞান, সাঁইজি একজন সার্থক রুপকার হিসেবে তাঁর বানীতে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুন মুন্সিয়ানায়।
বাংলা ভাষাভাষীর জন্য সাঁইজির নির্মাণ এক অনুপম আশীর্বাদ। তাই আরশিনগরের পড়শির সন্ধান পেতে, গুরুর পাঠশালায় ভর্তি হয়ে, দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করতে হবে সবার আগে। নচেৎ লালন বানী পড়শির মতোই অধরা থেকে যাবে জনমভর। আরশি নগরের পড়শির সার্বিক তথ্য, যোগাযোগের ঠিকানা আর কোন দিন কোন সময় পড়শির সাথে দেখা হয়, এসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ তত্ত্বের গভীর হতে গভীরতম আলোচনা, ব্যাখ্যা, আর আত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রত্যেকের নিজ নিজ জ্ঞানগুরুর কাছ থেকেই জেনে বুঝে নেয়া উচিৎ। অথবা  একজন আত্মতাত্ত্বিক দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন  পাকা সাধকগুরুর সান্নিধ্য নিয়েই সকল মানুষের আত্মদর্শনের জ্ঞান আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।

তথ্যসুত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন»
  সম্পাদনা»  গবেষণা» 
 কালের লিখন

সত্য বল সুপথে চল ।। লালনবাণীর প্রকৃত পাঠ

সত্য বল সুপথে চল
ওরে আমার মন,
সত্য সুপথ না চিনিলে
পাবি না মানুষের দরশন।
ফড়িয়ার মহাজন যেজন,
বাটখারাতে করে ওজন,
গদিয়ান মহাজন যেজন,
বসে কিনে প্রেমরতন।
পরদ্রব্য পরনারী হরণ করো না,
পারে যেতে পারবে না,
যতবার করিবে হরণ,
ততবার হবে জনম।
লালন ফকির আসলে মিথ্যে,
ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে,
সহি হলো না একমন দিতে,
আসলেতে পড়ল কম।

আলোচ্য বানীর রুপক শব্দের শব্দার্থ বিন্যাস
সত্য, সুপথ, ফড়িয়ার মহাজন,  গদিয়ান মহাজন, প্রেমরতন, পরদ্রব্য পরনারী, হরণ, জনম, তীর্থ, সহি।
সত্য»  যথার্থ, বাস্তব, নির্ভুল, সঠিক, ঠিক, নিত্যতা, অনশ্বরত্ব, সত্তা, বিদ্যামানতা, প্রতিজ্ঞা, শপথ, দিব্যি, কিরা, যথার্থ জ্ঞান,  নিশ্চয়, অবশ্যই। (সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন, সত্য সুপথ না চিনলে পাবি না মানুষের দরশন- লালিত লালন)
সুপথ»  সুপন্থা, সদুপায়, সৎপথ, উত্তম পন্থা, প্রকৃত পথ, আধ্যাত্মিকপথ, ভেদবিদ্যার পথ।
সত্যসুপথ» সঠিকপথ, সত্যপথ, সোজাপথ, আধ্যাত্মিকপথ, আত্মতত্ত্বের পথ।
মহাজন» সাধু, সন্ন্যাসী, মুনি, ঋষি, যোগী, বিবাগী, বিরাগী, ভিক্ষু, শ্রমণ, বণিক, ব্যবসায়ী, ব্যাপারী, উত্তমর্ণ, কুসীদজীবী, বৈষ্ণব পদকর্তা, আড়তদার, অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক মতানুসারী ব্যক্তি, মহৎব্যক্তি, সুদ নিয়ে ঋণ দেয় যে, তপস্বী, বিবাগী, বিরাগী, বৈরাগী, মুনি, যোগী, চাতক, সাধক, উপাসক।
ফড়িয়ার মহাজন» ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট বণিক, ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করা বণিক।
গদিয়ান মহাজন» নির্দিষ্টস্থানে বসে ব্যবসা বাণিজ্যকারী, সিদ্ধসাধু, সুশুদ্ধ সাধক, নির্বাণ লাভকারী সাধক।
প্রেমরতন» প্রেমরূপ রতন, প্রেমের বিনিময়ে পাওয়া যায় যে রতন। মাতৃজঠরে সর্ব জীবের ভ্রণ লালন-পালনকারী সুমিষ্ট, সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রুপকের আচ্ছাদনে  স্বরূপ বলা হয়।  আরও কিছু রুপক শব্দ হলো-  পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, গার্ডিয়ান, রব, উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ, খোদা, উপাস্য, পালক, সাঁই প্রভৃতি।
পরদ্রব্য» পরের দ্রব্য, নিজের নয় এরকম। অন্যের দ্রব্য, অপরের দ্রব্য। আত্মতাত্ত্বিক রুপকারদের মতে- পুরুষের শুক্র হচ্ছে পিতৃধন, আত্মতত্ত্বে শুক্রকে পরেরদ্রব্য বলা হয়। এর আরও কিছু রূপক পরিভাষা এরকম- জল, পিতৃধন, বৈষ্ণবী, অহল্যা, কালী, দুর্গা, সীতা, আদম আংগুর, খেজুর, রুটি, ফল, ধন, অমূল্যধন, পিতৃধন।
পরনারী» পরের নারী, অন্যের নারী, অপরের নারী। আত্মতাত্ত্বিক সাধুরা শুক্র কে সব সময় নারী চরিত্রে ধরে তাঁদের দেহতত্ত্বীয় বানী নির্মাণ করেন, এখানে পরনারী বলতে পুরুষের শুক্রকে বুঝানো হচ্ছে, আত্মতত্ত্বে পুরুষের শুক্রকে পরেরনারী বলা হয়। এর আরও কিছু রূপক পরিভাষা এরকম- জল, পিতৃধন, বৈষ্ণবী, অহল্যা, কালী, দুর্গা, সীতা, আদম আংগুর, খেজুর, রুটি, ফল, ধন, অমূল্যধন, পিতৃধন।
হরণ» চুরি, লুণ্ঠন, নাশন, ধ্বংস, নাশ, অপহরণ, মোচন. অপনোদন, দূরীকরণ, পরদ্রব্য জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়া, ভাগকরণ।
জনম» ‘জন্ম’ পরিভাষাটির কোমলরূপ, জন্ম, প্রসূত, ভূমিষ্ট, উৎপত্তি, উদ্ভব, সৃষ্টি, দেহধারণ, আকারধারণ, আবির্ভাব, জীবনকাল, দেহাশ্রিত অবস্থা। আত্মতাত্ত্বিকদের মতে, পিতা- মাতার  সন্তানরূপে পুনর্জন্মগ্রহণ, মিলনের সময় পিতামাতার দেহ ভেক্সেগ রসে পরিণত হয়, অতঃপর শুক্রপাতরূপ মৃত্যু দ্বারা তা গর্ভাশয়ে গিয়ে প্রায় ৩০৯ দিনের ব্যবধানে পুনরায় নতুন দেহ ধারণরূপ জনম হয় মানুষের। জনমের আরও কিছু শাব্দিক প্রতিশব্দ হলো-  পুনর্জন্ম, পুনরুত্থান, পরর্জন্মান্তর, পুনরুদ্ভব, পুনরুত্থান, পরকাল, পুনর্জনম, পুনর্জীবন, পুনর্জাগরণ, পুনরাগমন, দেহান্তর, কায়ান্তর, পরজনম।
তীর্থ»  পুণ্যস্থান, পবিত্রস্থান, পাপমোচন স্থান, বিশেষ পুণ্যস্থানরূপে প্রসিদ্ধ, প্রতীতি ও মহাপুরুষগণের অধিষ্ঠানভূমি, ঘাট, গুরু, শিক্ষক, ঋঝি সেবিত পবিত্র জল, জলাশয়ে অবতরণ বা স্নানের ঘাট, আত্মতাত্ত্বিক রুপকারদের মতে- তীর্থ হচ্ছে জননতন্ত্র বা কানাই। এর আরও কিছু রূপক পরিভাষা এরকম- অযোধ্যা, গণ্ডগ্রাম, গোকুল, গোষ্ঠ, নাগিনী, ব্রজ, রজকিনী, করক্সগ, গোয়াল, চিতা, চুলা, নৌকা, কালনাগিনী।
সহি» সাক্ষর, ছাপ, হস্তছাপ শুদ্ধ, বিশুদ্ধ, খাঁটি, ঠিক, নিখুঁত, সঠিক, নির্ভুল।

আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
আত্মতত্ত্ব দেহতত্ত্বের প্রাণপুরুষ, সাধককুল শিরোমণি বাঙালি ভাষাভাষীদের জন্য মহান রূপকার, বাংলাভাষার মরমিকবি, আত্মতত্ত্বের জনক মহাত্মা লালন সাঁইজি।  মহান আধ্যাত্মিকজ্ঞানতাপস ও জীবন ঘনিষ্ঠ  আত্মতাত্ত্বিক দার্শনিক মহাত্মা লালন সাঁইজি একজন সুমহান রূপকার হিসেবে রুপকের অন্তরালে আত্মতত্ত্বের কথা বলে গেছেন তাঁর নির্মিত সকল বাণীতে, সাঁইজির বাণীর মূল শিক্ষা হলো- মানব জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য নিজেকে জানা অতি জরুরী, মানুষতত্ত্ব- শ্রেষ্ঠতত্ত্ব, ভাব নয় বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে মূলে ধাবিত করে। সাঁইজির প্রতিটি সহজ পদ আত্মদর্শনের অমিয় বাণী, এর তাল, লয়, ছন্দ, ভাব, ভাষা, শব্দের গাঁথুনি, উপমাশৈলী আর রুপকের অন্তরালে মূলকের আভাস, মোহিত করে অনুসন্ধিৎসু মন।

মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, সাঁইদর্শন, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই সাঁইজির উদাত্ত কণ্ঠের আহব্বান- “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন, সত্য সুপথ না চিনলে, পাবি না মানুষের দরশন।”

সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।

আলোচ্য বানী দ্বারা সাঁইজি সারা বিশ্ববাসিকে সত্য ও সুপথে আগমনের জন্য উদাত্ত আহব্বান জানিয়েছেন। সকলদল, সকলমত, সকলপথ, সকল ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক মতবাদের সর্বস্তরের মানুষকে উন্মুক্তভাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে, সত্য ও সুপথে আগমনের জন্য। সাঁইজি রুপকের আচ্ছাদনে আরও বলে গেলেন, প্রকৃত সত্য আর নিরেট সুপথ না চিনলে তরলমানুষ সাঁইয়ের সন্ধান পাওয়া যাবে না কিছুতেই।

পদার্থবিজ্ঞান প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে- ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি পদার্থের তিনটি অবস্থা- কঠিন, তরল ও বায়বীয়। পদার্থের এ তিনটি অবস্থাকে আত্মদর্শনে আকার, সাকার, নিরাকার বলা হয়। যেহেতু মানুষ একটি পদার্থ, এবং আমরা আকারধারী কঠিন পদার্থের মানুষ, তাই আমাদের তরল ও বায়বীয় রূপ বা সাকার ও নিরাকার রূপ অবশ্যই আছে। তাই সাঁইজি সহজ করে বললেন- আকারধারি কঠিন মানুষ তো আমরা সবাই, আমাদের চারপাশে অজস্র আকারধারি মানুষ। এই মানুষের মাঝেই বাস করে তরল পদার্থরূপ সাকার মানুষ আর বায়বীয় পদার্থরূপ নিরাকার মানুষ। যদি সে সাকার আর নিরাকার মানুষের দরশন পেতে চাই আমাদেরকে অবশ্যই সত্য ও সুপথ চিনতে হবে। আকারধারি কঠিন মানুষের উপাস্য হলো, তরল পদার্থরূপ সাকার মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের দরশন পাওয়াই সাধকের প্রকৃত সাধনা। একজন অস্থায়ী বা ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরূপ ফড়িয়া মহাজন বা সাধক নিত্যবস্তু বাটখারায় ওজনে ব্যস্ত, এদের বৈষয়িক ধ্যান ধারনায় কেবলই বিষয়বিষ। অন্যদিকে প্রকৃতসাধক বা গদিয়ান মহাজন উপাস্যরূপ সাঁই বা প্রেমরতন কেনায় অধীর হয়ে চাতকের ন্যায় বসে থাকেন। তাই মহাত্মা লালন সাঁইজি বলছেন- ফড়িয়ার মহাজন যেজন, বাটখারাতে করে ওজন, গদিয়ান মহাজন যেজন, বসে কিনে প্রেমরতন।

আমরা সারাদিন মিথ্যে বললে আর কুপথে চললেও, ইচ্ছে থাকুক আর না থাকুক চারপাশে মানুষ দেখতে বাধ্য, কিন্তু সাঁইজি যে বললেন- সত্য আর সু-পথ না চিনলে সেই মানুষের দর্শন পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আমাদের বুঝে নিতে হবে চলমান পৃথিবীর আকারধারী মানুষের কথা এখানে বলা হয়নি, বলা হয়েছে মানুষের ভিতরে যে আরেক মানুষ বসবাস করে তার কথা।
আত্মতাত্ত্বিক সাধুরা বলেন- সেই স্বরূপ মানুষের দর্শন পেতে হলে গুরু ধরে সঠিক, সত্য আর সুপথ চিনতে হবে, জানতে হবে সেই মানুষের করণ কার্য। অটল হয়ে জন্ম মৃত্যু রুদ্ধ করে সেই মানুষের সন্ধানে যেতে হবে, করতে হবে প্রকৃতি হয়ে প্রকৃতির সাধন। আত্মতাত্ত্বিক সাধুদের মতে- পুরুষের শুক্র হলো তার পিতৃধন, এটা নিজদ্রব্য নয়, পরের দ্রব্য, একে মজুদ করতে হবে এক নিরিক্ষে, আত্মতত্ত্বে শুক্র কে সব সময় নারী চরিত্রে ধরা হয়, যেমন রাঁধা, সীতা, রূপকাররা রূপক ভাষায় এই শুক্রকে পরনারী বলে থাকেন। আগে মন হও প্রকৃতি, প্রকৃতি স্বভাব ধরে, সাধন করে হও ঊর্ধ্বরতী। যে আছে ষড়দলে, সাধ তাঁরে উল্টা কলে, এরূপ সাধন করলে, দ্বি-দলে জ্বলে উঠে জ্যোতি।

কিছুতেই পরনারী পরদ্রব্য হরণ করা যাবেনা, যদি আমরা পরনারী পরদ্রব্য রুপ শুক্র হরণ করে কামনদীতে মৃত্যু বরণ করি, যতবার মৃত্যু বরণ করবো, ১০ মাস পর পুনর্জন্ম রুপ আবার আমরা জন্মগ্রহণ করবো। যতক্ষণ একজন মানুষ গুরুর দীক্ষা নিয়ে নিজের শুক্রনিয়ন্ত্রণ করতে না পারবে, সে বার বার পরনারী পরদ্রব্য হরণ করবে আর বারবার জন্ম লাভ করবে, কিছুতেই তার আত্মার মুক্তি হবেনা। তাই সাঁইজি বললেন- পরদ্রব্য পরনারী হরণ করো না, পারে যেতে পারবে না, যতবার করিবে হরণ, ততবার হবে জনম।
সাঁইজির বানীতে অসংখ্য মানুষের কথা বলা হয়েছে- ভাবের মানুষ, মনের মানুষ, প্রেমের মানুষ, রসের মানুষ, সরল মানুষ, উবুদ মানুষ, আপন মানুষ। আমরা যারা লালনপ্রেমী সাধু, প্রায় প্রত্যেকে বিশ্বাস করি, লালন জাত পাতের উর্ধে উঠে মানুষের জয়গান গেয়ে গেছেন, সেই মানুষের খোঁজে আমরা ঘুরে বেড়াই দেশ হতে দেশান্তর, মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়, মাজার বাজার হাটে ঘাটে, জাগরণে স্বপ্নে, দেখায় না দেখায়, ঘুরি বেড়াই মক্কা মদিনা, গয়া কাশি বৃন্দাবন। তীর্থে তীর্থে চাতকের মতো আমাদের পদচারনা বিশ্বের পথ থেকে প্রান্তরে। অথচ দেহনামক একটি সার্বজনীন বিশ্বের খোঁজ নিলাম না জনমভর, যারে আকাশে পাতালে খুঁজি, সে যে আমার মাঝেই বসবাস করে একবারও তার খোঁজ নিলাম না, আমাদের মনের ভ্রান্তি ঘুরিয়ে মারলো বনে বনে, দিশাহীন এক ভ্রমণের অভিযাত্রী আমরা সবাই জানিনা সামনে কী, বুঝিনা করণ কার্য মানিনা অবধার্য- তাই লালন সাঁইজি বলছেন- লালন ফকির আসলে মিথ্যে, ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে,  সহি হলো না একমন দিতে, আসলেতে পড়ল কম।
আত্মদর্শন কোন ভাবের গোলাজল নয়, বিজ্ঞান আর আত্মদর্শন একে অপরের হাত ধরে চলে, বিজ্ঞান যেমন যুক্তি প্রমাণ আর বিশ্লেষণে আগ্রহী তেমনি আত্মদর্শনও নগদে বিশ্বাসী এখানে বাকীর কারবার বা লেনদেন নাই, যা সত্য, সুন্দর, সাবলীল আর অনুপম, যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, যা মানুষকে তাঁর মূলে ধাবিত করে, সন্ধান দেয় পরম সত্যের তাই আত্মদর্শন, মানব দর্শন। পৃথিবীর সুপ্রাচীন কাল থেকে অধ্যাবধি কিম্বা আজ থেকে আরও কয়েকশ বছর পর, যতদিন যেখানে মানুষ থাকবে, সেখানেই আত্মদর্শন কার্যকর। আত্মদর্শন সর্বযুগে সব মানুষের জন্য একই রকম।
আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, সেই মানুষের দর্শন পাবার জন্য, সেই মানুষের আবাস নিবাস সাধন ভজন পূজন সহ এসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ তত্ত্বের গভীর হতে গভীরতম আলোচনা, ব্যাখ্যা, আর আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রত্যেকের নিজ নিজ জ্ঞানগুরুও থেকেই জেনে বুঝে নেয়া উচিৎ।
অথবা  একজন আত্মতাত্ত্বিক দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন পাকা সাধকগুরুর সান্নিধ্য নিয়েই সকল মানুষের আত্মদর্শনের জ্ঞান আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।
তথ্যসুত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন»
  সম্পাদনা»  গবেষণা» 
কালের লিখন


বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়- ঋদ্ধ এই অনুভব অতুলনীয় ।। কালের লিখন

পৃথিবী দৃশ্যময়, যা অদৃশ্য তাই অসার। সারবস্তুর খোঁজে প্রতিটি মানুষ জীবন নামের ট্রেনে পরিভ্রমণে রত। এই পরিভ্রমণে সকল দৃশ্য চোখের সীমা আর বোধের চৌহদ্দি পেরিয়ে, মনের অভ্যন্তরে গিয়ে চেতনার কার্নিশে দোল দিতে পারে না। কিছু দৃশ্য নিজস্বতার ছাঁপ রাখতেই প্রিয় হয়ে ওঠে, মানুষ মূলত সেই সব প্রিয়তার কাছেই বারবার নতজানু হয়। বিজ্ঞান একে হয়তো স্মৃতি বলবে, দর্শনশাস্ত্র বলবে স্মৃতিকাতরতা। প্রিয় সব দৃশ্যের আড়ালে বা ফাঁকফোঁকরেও কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয় থেকে যায়। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের দ্বাদশ কবিতার বই- ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’। 
মননশীল পাঠক মাত্রই জানেন, কবি তার সময়কে ধারণ করেন, অনাচার অবিচার মিথ্যে আর কলুষতাকে বারণ করেন। বোধের রোদ পোহানো, অসংখ্য মানবিক মানুষের অনুভব হরণ করেন। দীর্ঘ আট বছর পর- কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের যাপিত সময় পরিভ্রমণের ইতিবৃত্ত শব্দের আলো-ছায়ায়, ভাবের ব্যঞ্জনায় আর প্রকাশের দ্যোতনায় অপরূপ কিছু দৃশ্যকল্পে উপস্থাপিত হয়েছে এই কবিতাগ্রন্থে। কবি যাকে বলছেন- ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’। ৫৩টি কবিতার সারমর্ম জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠে বইয়ের প্রচ্ছদে চোখ রাখলেই। নান্দনিক প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর এর প্রলুব্ধ চেতনায় আঁকা, উপলব্ধহীন অকারণ একটা দৃশ্য, ব্যাকরণ বিভোর চোখকেও বিশ্বাস করতে বাধ্য করে- কিছু দৃশ্য সত্যিই অকারণে প্রিয় হয়ে উঠে। কিছু দৃশ্য সময়ের রুপালী নৌকোয় বাঁধা থাকে স্রোতহীন অশ্রুত বেদনার ঘাটে। বইয়ের প্রথম কবিতার ডাকনাম- ‘শব্দ’। চলুন নিঃশব্দে পাঠ করি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান এই কবির কবিতাটি-

‘কবির বেহালা শব্দ, শব্দই কবির বেহালা
ঢেউ-ঢেউ নদী তার ধ্বনি
শব্দকে বাজালে নদী কথা বলে; রূপসী রাত্রিরা খোলে মুখ
শব্দকে কাঁদালে কাঁদে ডাকাতিয়া বিলের ডাহুক

শব্দই কবির প্রেম; সে ঢোকে নিঃশব্দ পায়ে মনে
শব্দের ডুবুরি কবি; শব্দে বাঁচে ডুব-সন্তরণে’

দাড়িহীন কবিতাটি যেন মহাকালের ব্যাপ্তি ছুঁয়েছে। কানে বাজে কবির শব্দের বেহালা, সময়ের রুপকে মোড়া ‘নদী’ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই শাব্দিক বেহালার ধ্বনি, কবি বলছেন- শব্দকে বাজালে নদী কথা বলে। আমরা সত্যি সেই সময় নামক নদীর কথা শুনতে পাই। শব্দকে বাজালেই রূপসী রাত মুখ খোলে, আবার ডাকাতিয়া বিলের ডাহুক কেঁদে উঠে, যদি শব্দের বেহালা কাঁদে। শব্দই কবির প্রেম, কবি শব্দের ডুবুরি, ভাবের জলে এবার শুনতে পাই শব্দের ডুব-সন্তরণ। শব্দ আর কবির এই যুগল মিলন, সত্যদ্রষ্টা কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের উপলব্ধিজাত অনুপম অনন্য উচ্চারণ।

দ্বিতীয় কবিতা ‘মেদেনীদুপুর’। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সাবলীল সাক্ষর এই কবিতার শরীর জুড়ে, কিছু অকারণ প্রিয় দৃশ্য তো আছেই, চলুন একটু দোল খেয়ে আসি- শাহরিয়ারের অন্তমিলের দোলনায়-

‘বাঁচি তো এবার শীতে বৃন্দাবনে যাব
পারসোনাল ট্যুর
আমাকে ডেকেছে রাঙামাটির শহরে
মেদেনীদুপুর

আগেও গিয়েছি ঐ কাব্যজনপদে
কবিদের দেশ
কে এক কুমোর কবি আমাকে দিয়েছে
মাটির গণেশ

তোমার অনেক কথা রোজই আমি শুনি
গণেশের মুখে
কপালে সুরেলা হাত অনুভব করি
অসুখেবিসুখে

সে-হাত যেখানে থাক, পুনর্বার গেলে
টেনে নেব কাছে
কোকিলও আগাম এসে বেহালা বাজাবে
রাধাচূড়াগাছে’

ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যকল্পের স্বল্প আলোয়, আবু হাসান শাহরিয়ার একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন আর জনপদের তত্ত্বতালাশ দেন আমাদের। কুমোর কবির মাটির গণেশ হস্তান্তর আর কবিদের দেশ সেই কাব্যজনপদে আর একবার গিয়ে সেই সুরেলা হাত কাছে টেনে নেবার আকুতি মনের ভিতর আর একটা মনের উপস্থিতি দাঁড় করিয়ে দেয়, যেন একটা দৃশ্যের মধ্যে আর একটা দৃশ্য, একটা গল্পের মধ্যে আর একটা গল্প, একটা জীবনের মধ্যে আরও অজস্র জীবন, একটা দুপুরের মধ্যে আর একটা মেদিনীদুপুর। কবির খণ্ড খণ্ড শব্দপ্রলয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হাপুরহুপুর।

‘এক চাবিতে দুজন আমি’ কবিতায় আমরা আর একজন শাহরিয়ার এর সন্ধান পাই-

‘বসো শাহরিয়ার, চা বানিয়ে আনছি’- নিজেকে বসিয়ে রেখে চা বানাতে যাই। ‘দরজাটা লাগাও শাহরিয়ার’ বলে বাইরে বেরই। চাবি একটাই দুজন আমি। আমার আমিদের নিয়ে আজকাল আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি। কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। ফলত প্রতিদিন কিছু না কিছু ভুল হয়ে যায়। গতকাল আয়নাকে দরজা ভেবে অতিথিকে ঘরে ঢুকিয়ে দুই কাপ চা বানিয়ে এনে দেখি, ঘরে কোনও অতিথিই নেই। এসময় অন্য শাহরিয়ার বাড়িতে ছিল না। কাল রাতে সে আর বাড়িই ফেরেনি। আমার উৎকণ্ঠা এখন ওকে নিয়ে। যাই, থানায় একটা অভিযোগ লিপিবদ্ধ ক’রে আসি। বেরুনোর সময় দরজাটা যে কাকে লাগাতে বলব, সেটাই ভাবছি।

ভাবনা বিলাসী পরম চেতনায় নিজেকে নিজের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেওয়ার সাহস শুধুমাত্র আত্মঅন্বেষু পরমনিষ্ঠ স্বভাব কবির-ই থাকে, যে কবি মুহূর্তে মুহূর্তে অকারণে কিছু প্রিয় দৃশ্য আঁকে। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এক চাবি হাতে নিয়ে দুইজন আমি’র স্বরে হাঁকে। এভাবেই কত মানুষ প্রত্যহ তলিয়ে যায় ভাবনার পাঁকে। শুধু শব্দের বেহালা যার হাতে, সেই-ই সময় নদীর কূলে ডুব-সন্তরণে একার সন্ন্যাসে মগ্ন থাকে।

সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন শাখা নিঃসন্দেহে কবিতা। সুগঠিত একটা কবিতার দুটি লাইনের ব্যাখ্যা দিয়ে অনায়াসে দুই হাজার শব্দের প্রবন্ধ লেখা যায়। অবাক বিস্ময়ে ভাবতে ইচ্ছে করে- কবিতার এক একটি শব্দ উচ্চকিত ঢেউয়ের মতো, মুহূর্তে প্লাবিত করে দিতে পারে ভাবসমুদ্রের এপার ওপার, চেতনার এধার ওধার। কবিতার এক একটা লাইনের ভার অনেক ব্যাপক। কথাসাহিত্য যেখানে ভাবকে ক্রমাগত বহির্মুখী করে বিভিন্নভাবে তার প্রকাশ আর ভাবোন্মোচন করতে থাকে, কবিতা ঠিক তার উল্টো পথে ধাবমান, সে ভাবের মাঝেও মহাভাবের জন্ম দেয়। মূলকের প্রলয় ভেদ করে আঁকতে বসে রুপকের রুপ-শ্রী। চলুন পড়ি, আবু হাসান শাহরিয়ারের দুই লাইনের একটি কবিতা, কবিতার ডাকনাম- ‘পরাবাস্তবতা’

মানুষের অ্যাকুয়ারিয়াম- নগর
মাছের নগর- অ্যাকুয়ারিয়াম

লাইন দুটো পাঠ মাত্রই মুহূর্তে মনে হয়, আমিও এক অ্যাকুয়ারিয়াম নগরের বাসিন্দা। যে নগরের আছে আবার হাজার হাজার গল্প। ছোট পরিসরে কবি পরাবাস্তবতা কবিতায় এঁকে দিলেন যাপিত কালের এক নিষ্ঠুর মনোকল্প।

একরকম আরও একটি কবিতা- ‘ব্যঞ্জনা’

.
সাঁকো গড়ো মনে ও মননে শব্দই ব্রহ্ম তাকে ব্যঞ্জনায় বাঁধো
.
বাজালে পাথরও বাজে; কঠিন পাহাড়ই সব সুরস্রোতা নদীর জননী

এ যেন সীমার মাঝে অসীমের গান, চেতনার ভাঁজে ভাঁজে নতুন ভাব, ভাবনা আর দ্যোতনার বিচ্ছুরণ।

সর্বশ্রেষ্ঠ আলোচনার নাম আত্মসমালোচনা। অথচ আমরা অধিকাংশ মানুষই এই কাজে বোধকানা। চলুন পাঠ করি, কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘আত্মসমালোচনা’ কবিতাটি-

‘পাতায় জলের ফোঁটাঃ পাতাটা কচুর
পলকে গড়িয়ে যাওয়া ফোঁটাটা জীবন

অস্থায়ী খুঁটিই যার নড়বড়ে
স্থায়ী ঠিকানার লোভে তারও কত ভিটা-ভিটা সাধ
মানুষের মতো লোভী প্রাণী
পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই
অথচ নিজেকে নিজে ‘শ্রেষ্ঠ’ দাবি করে
নদীর আয়নায় আমি কুৎসিতদর্শন সেই প্রাণীটিকে দেখি

আমার মানুষ-মুখ কতটা কদর্য, আমি জানি’


এই যে একজন কবির পরমসিদ্ধ উপলব্ধি আর প্রজ্ঞার অনুরণনে নির্মোহ উচ্চারণ- ‘আমার মানুষ-মুখ কতটা কদর্য, আমি জানি’ এই সত্যপ্রিয় স্বমুখদর্শিত কবির অনন্য কাব্যিক আয়োজন ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’। 

সদ্য প্রয়াত কবি রফিক আজাদকে পাই- ‘গ্র্যান্ডমাস্টার রফিক আজাদ’ কবিতায়-

‘সব বাদ অস্ত গেলে থাকে মৃত্যু বাদ
মৃত্যুর এপারে ব’সে
গ্র্যান্ডমাস্টারের চালে দাবা খেলে রফিক আজাদ’

কিম্বা ‘জীবনানন্দ দাশ সমকালেই বুদ্ধদেব বসুর বোধগম্য ছিলেন’ কবিতার সেই চিরন্তন উচ্চারণ-

‘নদীসব নৃত্যপটিয়সী
কবিতাও নৃত্যপ্রিয়; কবিতারও নদীর স্বভাব
শব্দগুলো ঢেউ

গাছপাকা কথা এইঃ সকলেই কবি নয়; কবি কেউ-কেউ’

মানুষের ডাকনাম চিত্রায়ন করতে গিয়ে কবি ‘আশ্বাসঘাতক’ কবিতায় লিখলেন-

‘আবারও আসবে ব’লে সূর্যের রোজই অস্ত যাওয়া। সূর্য কথা রাখে। ঢেউ-ঢেউ নদী কথা রাখে। ‘ফের দেখা হবে’ বলে কোকিলও বসন্তে ফিরে আসে। একবার চ’লে গেলে মানুষ ফেরে না। কথা দিয়ে কথা সে রাখে না। মানুষের ডাকনাম- আশ্বাসঘাতক’।

মানুষের প্রথাসিদ্ধ ডাকনামে, মুহূর্তের জন্য আশ্বাসপ্রিয় মন নিরাশায় দোলে উঠে। কোথাও কোথাও বেদনার ফুল শঙ্কার মতো ফুঁটে।

সত্যম কাব্যম সুন্দরম কবিতায় পাই কবি-ধর্মের চিত্রায়ন। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার যখন বলেন-

‘নিজের মাথায় ছাতা নিজেকেই মেলে ধরতে হয়। ছত্রধর বিপদসঙ্কুল। একাই হাঁটতে হয় জীবনের কিলো-কিলো পথ। গাড়ি-ঘোড়া অনিবার্য নয়। সত্যের দর্শনে লাগে কৃপাবিমুখতা। একই দাবি সুন্দরেরও।

কবির শাশ্বত ধর্ম- কৃপাবিমুখতা।’

তখন বোধের কম্পন জাগে কবি স্বত্বার নির্মোহ জীবনাচার আর অন্তর্নিহিত ভাব-প্রাচুর্যের বিন্যাস দেখে।

আবু হাসান শাহরিয়ার শুধুই সময়ের কবি নন, তিঁনি মুহূর্তকে ছেনে কবিতা নির্মাণ করেন, ছোট ছোট মুহূর্তের শাব্দিক চিত্রায়নে নির্মাণ করেন মহাকালের ছবি। ‘সোনামুখি সুঁই’ কবিতাটি এরকম একটি মুহূর্তগামী কবিতা, কিন্তু তার বিচরণ সময়ের প্রবাহমানতায়-

কেবলই অস্থির হয়- ভাঙে, জোড়া লাগে
মানুষের মন
নতুনও প্রাচীনপন্থী, মাটি খুঁড়ে তোলে
লুপ্ত প্রকরণ

দশকেই সঙ্ঘ ভাঙে, শঙ্খদার কথা
ঠিকই তো; আবার
পরাবাস্তবতা হাতে ফেসবুকও এক
যৌথ পরিবার

এখন যন্ত্রের যুগ, যান্ত্রিকতা ছাড়া
মেলে না কিছুই
সেফটিফিন আছে বটে, হারিয়ে ফেলেছি
সোনামুখি সুঁই

স্মার্টক্যামেরায় তোলা ছবিতে কত কী
দৃশ্য আসে যায়
আসে না বালিকা আর কাঁপনও লাগে না
ঝুলবারান্দায়

আবু হাসান শাহরিয়ারের শব্দেরা আপন দ্যোতিতে প্রীতিময়, ভাবনারা বৃক্ষের মতো ছায়াময়। বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠতার কূল ঘেঁষে সত্যনিষ্ঠ। তাঁর কবিতায় আশ্রয় আছে, আছে নিরীক্ষার মাঝেও চেতনার চুলচেরা স্ফুরণ।
একটা কবিতার সামান্য অংশ পাঠে সম্পূর্ণতার স্বাদ পাওয়া যায়না, যদিও কবিতা সর্বকালের জন্য এক অসম্পূর্ণ যাত্রা। আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘তারা মিঞা’ কবিতাটি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না-

‘পাঁচতারকা হোটেলের সভাকক্ষে একজন চারতারকা জেনারেল যেদিন জাতিকে গণতন্ত্র বোঝাচ্ছিলেন, সেদিন আমি হাওড়ের দেশে। জানো তো, কবির সাম্রাজ্য ঐ খাল বিল হাওড় নদীরা। রাতের শ্যালোনৌকায় আমি আর মাঝি যখন ধনু নদীকে নিয়ে গল্প করছি, তখন আকাশের সব তারকাই ছিল আমার আর মাঝির। কী আশ্চর্য, মাঝিটির নামও ছিল- তারা তারা মিঞা। ঐ রাতেই তারা মিঞাকে আমি আমার সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেই। কবির সাম্রাজ্যে সেনাপতিরা অযুত নক্ষত্রখচিত।’

অযুত নক্ষত্রখচিত সেনাপতির হাতে কালের বৈঠা, সামনে ধনু নদী। এরকম বোধ অনাদির আদি। আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতারা হঠাৎ করে কবিতা হয়ে উঠে, পুনঃপাঠে ধরা পড়ে আসলে কবিতার প্রতিটি শব্দ সুচিন্তিত, কোথাও বিন্দুমাত্র ফাঁকফোঁকর নেই। কোথাও জোর করে শব্দের শরীরে শব্দ চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নেই। যেন পূর্ব-নির্ধারিত কোন ছবি এঁকে যাচ্ছে একজন কলমসৈনিক, তাতে উঠে আসছে যাপিত জীবনের সমূদয় ভাবনা, যা নিত্য নৈমত্তিক।

আট আর দশ মাত্রার মধ্য বিভাজনে চমৎকার ব্যঞ্জনা নিয়ে গড়ে উঠেছে- ‘ভাঙা চাঁদই পরাবাস্তবতা’ কবিতার শরীর। কবিতার প্রথমাংশ-

‘বুড়িগঙ্গা ঘাটে বাঁধা      বনলতা বরিশালে গেছে
হাতিশালে হাতি নেই     বাড়ি তোলে এলিফ্যান্ট রোড
মুছে যাচ্ছে জলাশয়      মেগাসিটি ঝেড়ে কথা বলে
মাঠে নামে পুরাতত্ত্ব      ঘাস কাটে শপিং কমপ্লেক্স
মেশিনের পায়ে আঁঠা    যানজটে থেমে আছে প্রেম
স্মৃতিরা অ্যালার্ম ঘড়ি    গলা সাধে মোরগের ভোর
উঠোনে হাজার বেলি    পালকে মেঘের ডানা বাজে
চাতালে টিনের চালা     পালতোলা রিকশা ডেকে আনো’

পড়তে পড়তে পাঠক মনে ভেসে উঠে অসংখ্য ছোট ছোট দৃশ্য, আরও একটু ভাবলে প্রতিটি খণ্ড দৃশ্যের পিছনেই আর একটা বৃহৎ পরিসরের মস্ত গল্প। এইসব ছোট ছোট শব্দে আঁকা দৃশ্য অকারণেই প্রিয় হয়ে ওঠে পাঠকের মনে। ভাঙা চাঁদই পরাবাস্তবতা কবিতার শেষ দুটি লাইন-

‘প্রয়োজনই শেষ নয়; কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়
নোনা-পচা গল্পদেরও কবিতায় শয্যা পেতে দিও’


এরপর আর বলার কিছু থাকে না। সত্যি তো- প্রয়োজনই শেষ কথা নয়, এর বাইরেও অপ্রয়োজনীয় অনেক দৃশ্যই অকারণে আমাদের প্রিয় হয়ে উঠে। আর সেসব ছোট ছোট দৃশ্যের যোগফল আমাদের সমগ্র মানবজীবন। একজন কবিতাপ্রেমী পাঠকের কাছে এই বইয়ের পাঠ উন্মোচন সময়ের দাবি। এই ছোট্ট পরিসরে অজস্র বৃহৎ ভাবনা পরিবেষ্টিত কাব্যগুচ্ছের- আলোচনা কিম্বা অকারণে প্রিয় অজস্র দৃশ্যের মর্মভেদ, সমালোচনা বা পাঠ আলোচনা কোনটাই করার সুযোগ নেই। একজন নিমগ্ন পাঠক হিসেবে এই উপলব্ধিটুকুই পরম সত্য- কবি আবু হাসান শাহরিয়ার সত্যিকারের একজন শব্দের ডুবুরি। সময় নদীতে ডুব দিয়ে ভাবের ধ্বনি প্রকাশে উপযুক্ত শব্দ তোলে আনতে তাঁর জুড়িমেলা ভার। আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা স্বাতন্ত্র মেজাজে ভীষণ ক্ষুরধার।

শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৬

এক গুচ্ছ চিঠি ।। কালের লিখন

প্রিয় বারান্দা,
অনেকদিন বসা হয়না তোমার বুকে পাতা দোলচেয়ারে। দেখা হয়না চারপাশের ছায়াচিত্র। সকালের প্রথমরোদ, দুপুরের নিস্তব্ধ ক্লান্তি আর বিকেলের নীল আকাশ, কেমন দূরের মনে হয় আজ। মনে আছে তোমার? প্রথম দু'টো কাঁটাওয়ালা ক্যাকটাস আনলাম, তোমার বুকের এককোণে রাখবো বলে। একদিন বেখেয়ালে খোঁচা লেগে রক্তারক্তি কাণ্ড, ভিজে একাকার তোমার সাদা বুক। তারপর বারোমাস ছিলো আকাশ জুড়ে রক্ত ঝরার শোক। দীর্ঘদিন পর মাটির টবে এলো টকটকে গোলাপ, ছিটেফোঁটা রোদ্দুরে কেমন চকচকে হয়ে উঠতো একান্ত সময়গুলো। অনেক সময় বসে বসে ঝেড়ে দিয়েছি তোমার বুকের অস্থায়ী ধুলো। চোখের মাঝেও আর একটা গভীর দৃষ্টি আছে এই কথা ভাবতে ভাবতে কতদিন হারিয়ে গেছি গ্রিল ছুঁয়ে অনন্ত আকাশে। তখনো তুমিই ছিলে এক চিলতে অবসর, স্থিতিশীল আমায় ভালোবেসে। আমি আজ পথের পথিক, হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হওয়াই কাজ। তবুও মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু বাড়ির দিকে তাকালেই চোখে পড়ে তোমার মতোই কোন বারান্দা, বিশাল পৃথিবীর বুকে সামান্য আশ্রয়, এক জোড়া দর্শনপ্রিয় চোখ। হঠাৎ করেই মন খারাপ হয়, ভুলতে পারিনা প্রিয় বারান্দা, তোমার আকাশ হবার শোক।
কালের চিঠি- ০১ ।। কালের লিখন


প্রিয় বুনোফুল,
শেষ দেখা হয়েছিল যখন আমি সমুদ্রে নেয়ে, আকাশের সাথে কথা বলতে বলতে পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। তুমি ফুঁটে ছিলে উঁচু নিচু পাহাড়ি পথের ঢালে। তোমার সৌন্দর্যে রীতিমত কেঁপে উঠেছিলাম, যেন সদ্য যৌবনা কারও মৌবনের ঘ্রাণ মাতাল অবস্থা। চোখে চোখ পড়তেই তুমি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলে, ততক্ষণে ভাবুক মনের বাতাস ধরেছে উল্টো স্রোত। প্রকৃতি কি অনুপম, কি মায়াময় অদ্ভুত। কেউ দেখুক না দেখুক, ঘ্রাণ নিক না নিক, তুমি ফোটে আছো আপন মনে। জানো মুহূর্তে সেদিন কি মনে হয়েছিল? দুঃখু মিয়ার সেই নির্মোহ উক্তি- 'আমি বনের পাখি, গান গাওয়াই স্বভাব, কেউ শুনলেও গাই, না শুনলেও গাই।' সেই থেকে প্রতিদিন মনে মনে ভাবি- মানুষ বড়ই প্রশংসার অভাবী। তোমার আপন সৌন্দর্যে ফুঁটে উঠার জন্য কোন প্রেষণা প্রণোদনা প্রয়োজন হয়নি, দরকারের খাতায় ছিলো না আলোকচিত্রির ছবি তোলার অভিপ্রায়। তোমার ঘ্রাণ বিভোর চেতনায় ছিলো না সেদিন- কোন কবি কাব্য করুক তোমাকে নিয়ে। তবুও একান্ত মনের দায়ে, ভালোবাসার মধু ঘায়ে, আমি লিখছি তোমায় সাময়িক স্মরণপত্র। প্রিয় বুনোফুল, এখনো অবাক দখল করে আছো তুমি- দৃষ্টিমগ্ন কবির সৃষ্টিলগ্ন নেত্র।
কালের চিঠি- ০২ ।। কালের লিখন


প্রিয় আকাশ,
জানি প্রতিদিন অজস্র চিঠির ভারে ন্যুব্জ তোমার মেঘ পিওনের ডাকবাক্স। আমার সামান্য চিঠি, তোমার সীমাহীন বিশালতার কিছুই স্পর্শ করতে পারবে না। তাতে কিছুই যায় আসে না, আমি জলচক্রে বিশ্বাসী। তাই বিন্দু বিন্দু চোখের জলে তোমাকেই লিখছি। একথা তো সত্য- জলেরা বাষ্প হয়ে তোমার কাছেই ছুটে যায় আবারও জমাট বাঁধার প্রত্যাশা নিয়ে। অনেক কথার ভিড়ে হারিয়ে যাবার আগে তোমার প্রতি প্রথম প্রেমের গল্পটা বলে নেই- সেদিন স্কুল বন্ধ ছিল, শুক্রবারের কোন অলস বিকেল, গত দুই দিন তুমুল বৃষ্টি। মায়ের হাতের চিঁড়ার মোয়া খেতে খেতে অবোধ বালক আমি পলকে তাকালাম আমগাছের ফাঁকে একখণ্ড আকাশে, সদ্য বৃষ্টি থামা তোমার গায়ে তখন অপূর্ব সব রঙের রেখা। আরও বড় হয়ে জেনেছি সেটা রঙধনু। বারবার রঙ বদলের খেলা খেললেও সেই থেকে আমি তোমাকে আর ভুলতে পারিনি। এখনো মায়ের মুখ মনে পড়লেই আমি তোমাকে দেখি। বিশালতার উপমায় তুমি এসে হাজির হও ঔদার্য নিয়ে, বিষাদের রঙে কাব্য বিনির্মাণেও তোমার সাহায্য চাই। তোমাকে আমি চোখ বন্ধ করে, বন্ধ ঘরে কৃত্তিম ছাদের নিচে বসেও পাই। তুমি সীমার মাঝে অসীমের গুঞ্জরন তুলে, ভুল ভুলে ভাসিয়ে নিয়ে যাও আমাকে মেঘের ডানায়। তোমাকে পাই আমি লেখায়- আঁকায়। প্রিয় আকাশ- তুমি সবটা জুড়ে আছো অনুভবের ফাঁকায়।

কালের চিঠি- ০৩ ।। কালের লিখন


প্রিয় নদী,
ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি-"সময় আর নদীর স্রোত, কারও জন্য অপেক্ষা করে না" সেই থেকে তোমার নাম শুনলেই মনে হত তুমি প্রচণ্ড ধাবমান জলাধার। জানো? প্রথম কবে দেখলাম তোমাকে? -আমাদের দু'গ্রাম পাশেই এক নদী ছিল, নানী বাড়ি যেতে যেতে নৌকোয় পার হতাম এপার ওপার। সমতলে পা ফেলে বেড়ে উঠা আমি, তোমার জলের অথৈ দেখে, সম্মোহনী গভীরতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, জলের তুড়ে নৌকায় দোলে উঠেছিল আমার সমস্ত পৃথিবী। সেই থেকে নদী মানেই আমার প্রচণ্ড অস্থিরতার নাম। নদী মানেই আমার গহনে জলের ছলাৎ ছলাৎ। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে জেনেছি -নদী মানেই এপার ওপার ভেঙ্গে চুড়ে যাওয়া হুলস্থূল এক রমণীর নাম। যদিও- নদী মানেই আজকাল মরা চর, নদী মানেই আজকাল সরু খাল, দিকে দিকে দখলে নিয়েছে তোমায় পঙ্গপাল। তবুও হে প্রিয় নদী, তুমি আমার প্রবাহমান জলজ বিশ্বাস, জলমগ্ন অনন্ত মহাকাল।

কালের চিঠি- ০৪ ।। কালের লিখন


প্রিয় চাঁদ,
জানি তোমাকে নিয়ে হয়েছে বিস্তর কথার আবাদ। তোমার সৌন্দর্য প্রশ্নাতীত এই জগতব্যাপী। আমি সামান্য মাটির মানুষ, কি করে তোমার পরিসর মাপি? অনন্তকালের প্রেমপিয়াসী অন্তরে তুমি ঢেলেছ জোসনা সুধা। তুমি দিনের ক্লান্তি মুছে দিয়ে রাত এলেই আলোকিত করেছ ঘুমমগ্ন বসুধা। কতজন প্রাণপণ তোমাকে দেখেছে মিশিয়ে মনের মাধুরী। তুমি কত-শত বছরের পুরনো প্রেমবস্তু, আমি তো করছি সেদিনের বাহাদুরি। তবুও হে চাঁদ- একটুও মিথ্যে নয় আমার প্রেমময় ভালোবাসার শাব্দিক বিবাদ। আমি আকণ্ঠ পান করেছি তোমার চন্দ্রসুধা, এখনো তৃষ্ণার্ত আমি, মিটে নাই জোসনা বিলাসের ক্ষুধা। জানি- আমার মতো অজস্রজন করেছে তোমার বন্দনা, আরও শতাব্দীর পর শতাব্দী আসবে যাবে কতজন, কেউ তোমায় বলবে না মন্দ না। কবি লিখবে কবিতা, শিল্পী আঁকবে ছবি। গিলে খাবে আস্ত চাঁদ যারা সরল অভাবী। কেউ তোমায় প্রিয়া ভাববে, কেউ ভাববে বুড়ি নানী, এসবে কিছুই হবে না তোমার, তুমি তো ভাবের রাজধানী। শুধু একটা কথাই এই চিঠিতে বলবো তোমায় চাঁদ, তোমার কাছেই জেনেছি প্রথম- 'ভালোবাসা একটা ফাঁদ।' অসহ্য আলোয় তুমি এই বার্তাই দাও, জীবন ক্ষণস্থায়ী, একে লুটেপুটে নাও।

কালের চিঠি- ০৫ ।। কালের লিখন


প্রিয় হাসনাহেনা,
সেদিন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, আমার তখন কুড়ি। শরীরে মনে চনমনে প্রকৃতি সকাল বিকাল দোল দিয়ে যায়। গাছফুল, লতাপাতা অকারণে আকর্ষণ করে এবেলা ওবেলা। কবরের পাশে ফুলের গাছ লাগানো, তখনো মৃতের প্রতি পবিত্র অর্ঘ্য নিবেদনের পর্যায়ে। পাশের বাড়ির বুড়িটা অনেকদিন বিছানায় গড়িয়ে মরে গেছে, হঠাৎ করে বুঝতে পারি- বুড়ির কবর থেকে মাতাল এক ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কেমন ভয় পেয়ে গেলাম, আকাশে তখন চকচকে থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। অসহ্য সুন্দর আলোয় অদম্য আকর্ষিত ফুলের ঘ্রাণ, মুহূর্তে আমি গন্ধ মাতাল, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম কবরের দিকে। সেদিন কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই। ভোর হতেই- দু একজন নামাজি কবর জিয়ারত করতে এসে বলেছে- হাসনাহেনার গায়ে সাপ থাকে। আমি মুহূর্তে বোঝে নিয়েছিলাম- তোমার বিষাক্ত ঘ্রাণের তেলেসমাতি। আমি প্রথম উপলব্ধি করেছি- কাকে বলে মাতাল ঘ্রানানুভুতি। প্রিয় হাসনাহেনা, এখনো আমি তোমার গন্ধে মাতাল, যদিও এই শব্দগুচ্ছে মিটবে না সেই দেনা।

কালের চিঠি- ০৬ ।। কালের লিখন


প্রিয় বিষাদ,
সুখের অববাহিকায় সবাই নাইতে চায়। অথচ আমি তোমাকেই ভালোবাসি। পরিপূর্ণ প্রশান্তিতে মগ্ন হয়েও আমি, তোমাকে পেলেই হাসি। মুহূর্তে মুহূর্তে বোধের রোদে আমি তোমাকেই খোঁজে পাই। কাব্যে নাব্য হয়ে বিষাদ পুড়াই। তুমি গালফোলা সকাল, মরে যাওয়া দুপুর আর আক্রান্ত সন্ধ্যায় ঠাঁয় বসে থাকো আমার ভাবনার আঙিনায়। আমি তোমাকেই দেখি কেবল একমাত্র সহায়। তোমাকে দেখি আমি করুন ভিখারির চোখে, ঘুরে বেড়াও তুমি আর্ত-পীড়িতের মরা মুখে মুখে। তোমার ছায়া নিয়ে শিল্পী আঁকে ছবি, তোমাকে ছেনে দুঃখ এনে কবিতা সাজায় কবি। তোমাকে পাই অনুভবে, অসংখ্য না পাওয়ায়, তুমি উড়ে বেড়াও নষ্ট সভ্যতার ভ্রষ্ট হাওয়ায়।  প্রিয় বিষাদ, আমাকে ছেড়ে যেও না, যেখানেই থাকি, কুঁড়েঘর কিম্বা রাজপ্রাসাদ।

কালের চিঠি- ০৭ ।। কালের লিখন