মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

পাখি কখন জানি উড়ে যায় ।। কালের লিখন

একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়
পাখি কখন জানি উড়ে যায়।
খাঁচার আড়া পড়লে ধ্বসে, 
পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, 
সেই ভাবনা ভাবছি বসে, 
সদা চমকজ্বরা বইছে গায়। 
কারবা খাঁচায় কেবা পাখি, 
কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, 
পাখি আমারি  আঙিনায় থাকি, 
আমারে মজাতে চায়। 
সুখের পাখি যাবে উড়ে, 
খালি খাঁচা রবে পড়ে, 
সঙ্গের সাথী কেউ না রবে, 
লালন ফকির কেঁদে কয়।
আলোচ্য বানীর রুপক শব্দের শব্দার্থ বিন্যাস

খাঁচাপাখিআঙিনাচমকজ্বরাআড়া। 

খাঁচা» পিঁজরা, পিঞ্জর, পিঞ্জিরা, টক্সগ, টোপা, অস্থিপঞ্জর, কাঠামো, খাদ্যদ্রব্য ঢেকে রাখার খোপ খোপ ঢাকনি। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে দেহ বা রুপকের আচ্ছাদনে  খাঁচা  বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো- কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা প্রভৃতি। (খাঁচার আড়া পড়ল ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
পাখি»পক্ষী, বিহগ, বিহঙ্গ, জৈব্যতা, জীবনিশক্তি, ব্রহ্মশক্তি, সঞ্জীবনী, যে শক্তির বলে বীজ অংকুরিত হয়, বায়োগ্র্যাফি, স্বায়ম্ভু, স্বয়ংসৃষ্ট, স্বয়ং অস্তিত্বশীল, জৈব্যতা। প্রাণিদেহে ব্যাপৃত চৈতন্যময়সত্তা। আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা জীবকোষকে জীবাত্মার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সূক্ষ্মশক্তিকে জৈব্যতা বা রূপকার্থে পাখি বলে থাকেন। (একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়পাখি কখন জানি  উড়ে যায়। – লালিত লালন)
আঙিনা»  আঙ্গিনা, অঙ্গন, উঠান, প্রাঙ্গণ, কোল, ক্রোড়, বুক, কাঁখ। আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা ভগ হতে ভৃগু পর্যন্ত স্ত্রী জননপথকে বৈতরণী, কানাই বা রুপকের আচ্ছাদনে আঙিনা বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  বৈতরণী, গয়া, গণ্ডকী, ফল্গু, বিরজা, মন্দাকিনী, যমুনা, সুরধুনী, সুরনদী, সুড়ংগ জননপথ, মর্ত্যধাম হতে স্বর্গধামে গমনের একমাত্র নদী, ভেজাইনা, উঠান, ডাংগা, দুয়ার, নদী, খাল, নালা, ক্যানাল, বরজখ, বিরজা। (কার বা খাঁচায় কে বা পাখি, কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, পাখি আমারি আঙিনায় থাকি, আমারে মজাতে চায়- লালিত লালন)
চমকজ্বরা»(চমক+জ্বরা) অত্যন্ত আতংকিত ভাব, ভীষণ বিস্ময়ভাব, অত্যন্ত ভীত ও আতংকিত হওয়ার ফলে শরীরে উৎপন্ন তাপ, হঠাৎ বিস্ময় হওয়ার কারণে এবং অতিরিক্ত হৃদকম্পনের ফলে শরীরে উৎপন্ন তাপ (খাঁচার আড়া পড়লে  ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
আড়া» আকৃতি, গঠন, ডৌল, প্রকার, রকম, ধরন। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে কায়া বা রুপকের আচ্ছাদনে আড়া বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, উষ্ট্র, গাছ, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি।
(খাঁচার আড়া পড়ল ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, সাঁইদর্শন, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহব্বান জানানো হয়েছে।
সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।
আলোচ্য বানীতে সাঁইজি আত্মারূপ পাখির উড়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। কখন কোন বিমার বা বদ হাওয়ায় দেহরূপ খাঁচা ছেড়ে আত্মারূপ পাখি উড়াল দেয়। তাই সাঁইজি উদাসনেত্র মেলে তাকিয়ে থাকেন অনাগত দিনে আর গেয়ে উঠেন- একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়, পাখি কখন জানি উড়ে যায়।
বিমূর্তশক্তিই ধীরে ধীরে মূর্তমান হয়ে উঠে। শক্তির মূর্তমান এ রূপটিকেই বলে আকার, দেহ, কাঠামো বা খাঁচা। আগুন, জল, মাটি, বাতাস ও বিদ্যুৎ- এ পাঁচ উপাদানে জীবদেহ সৃষ্টি। দেহতাত্ত্বিকরা এই পাঁচ উপাদানকে একত্রে আদি পঞ্চভূত বলে থাকেন। দেহকে জীবিত বা প্রাণবন্ত রাখতে প্রয়োজন হয় প্রাণশক্তি বা আত্মা। তাই বলা যায় দেহ হলো আত্মারই মূর্তমান রূপ। আত্মা বিমূর্ত কিন্তু দেহ মূর্ত। বিমূর্তশক্তি হতে সৃষ্টি হয় মূর্তমান দেহ। আত্মা ছাড়া কোন দেহই কল্পনা করা যায় না। অপরদিকে খাঁচা বা দেহ ছাড়া আত্মার আশ্রয় অসম্ভব, তাই সাঁইজি বলছেন- খাঁচা যদি ভেঙ্গে যায়, যদি আদি পঞ্চভূতের সুষম সমন্বয় না হয় বিদ্যুৎ শক্তি রূপ আত্মা বা পাখি এসে দাঁড়াবে কোথায়? সাঁইজি ভাবছেন দেহযন্ত্র বিকল হলে সকল বৃথা, পাখি ফাঁকি দিবে, অত্যন্ত ভীত ও আতংকিত দেহ-চিত্তে সাঁইজি বলছেন- খাঁচার আড়া পড়লে ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, সেই ভাবনা ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়।
যখন দেহরূপ খাঁচা ছেড়ে একবার পাখি উড়ে যাবে তা আর পুনঃস্থাপিত হবেনা, একে অপরের কাছে অচেনা হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। কারো জন্য কারো ভাবনা নেই, নেই আঁখির জল। কোন কূল কিনারা থাকবেনা, কার খাঁচা আর কে পাখি। একদিকে দেহ পড়ে আছে নিথর, নিশ্চল, অন্যদিকে উড়ে গেছে দেহের পাঁচ উপাদানের একটি উপাদান বিদ্যুৎ শক্তি বা আত্মা, তাই সাঁইজি বলছেন-  কারবা খাঁচায় কেবা পাখি, কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, পাখি আমারি আঙিনায় থাকি, আমারে মজাতে চায়।
বিদ্যুৎ এক প্রকার শক্তি। এ শক্তি ছাড়া প্রাণীকূল ও উদ্ভিদকূল এক মুহূর্তের জন্যও বাঁচতে পারেনা, তাই এই তড়িৎ বা বিদ্যুৎ শক্তিকেই জীবের প্রকৃত জীবাত্মা বলা হয়। হৃদপিণ্ডের মাধ্যমে দেহে যখন রক্ত সঞ্চালিত হয়। তখন রক্ত কণিকার ঘর্ষণে এ বিদ্যুৎশক্তিটি জীবদেহে উৎপন্ন হয়। এ শক্তিটি জীবদেহে বিদ্যমান থাকাকে জীবের জীবিত থাকা বলা হয়। এ শক্তিটি দেহ হতে বিলুপ্ত হওয়াকে জীবের প্রয়াণ বলা হয়। কোন কারণে হৃদযন্ত্রটি বিকল হয়ে গেলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন বন্ধ হয়ে যায় এবং জীব প্রয়াণলাভ করে। একবার বিদ্যুৎ শক্তিরূপ আত্মা বা সুখের পাখি দেহ ছেড়ে গেলে শুধু খালি খাঁচা পড়ে থাকে যাকে আমরা মড়ক বলি, আত্মা, মন আর জ্ঞানহীন খালি খাঁচা বা দেহের কোন সঙ্গী সাথী নেই, তাই মহাত্মা লালন ফকির কেঁদে বলছেন- সুখের পাখি যাবে উড়ে, খালি খাঁচা রবে পড়ে, সঙ্গের সাথী কেউ না রবে, লালন ফকির কেঁদে কয়।
আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, সাঁইজি বারবার তাঁর বানীতে দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব আর আত্মদর্শনের কথা বলে গেছেন। পৃথিবীর সুপ্রাচীন আত্মতত্ব, দেহতত্ত্ব, আর আত্মদর্শনের সার্বিক পরম্পরাজ্ঞান , সাঁইজি একজন সার্থক রুপকার হিসেবে তাঁর বানীতে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুন মুন্সিয়ানায়। বাংলা ভাষাভাষীর জন্য সাঁইজির নির্মাণ এক অনুপম আশীর্বাদ।
একজন মানুষের চারটি মূল সত্ত্বা- দেহ, আত্মা, মন আর জ্ঞান। একজন মানুষ যখন তার দেহের বিস্তারিত জানবে, পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গের ব্যাবহার বিধি জানবে, আত্মার প্রকারভেদ আর আত্মমুক্তির পথ জানবে, মনের প্রকারভেদ আর কার্যকরণ জানবে, সেই সাথে জানবে জ্ঞান বা মহাত্মার খুঁটিনাটি তখনি তার দিব্যজ্ঞান উদয় হবে।
আলোচ্য বাণীর আলোকে বলা যায়- আত্মার প্রকারভেদ, আত্মার অবস্থান, দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক, আত্মা অক্ষয়, অমর ও শ্বাশত নাকি ধ্বংসশীল? আত্মা ও দেহ কোনটি আগে সৃষ্টি, আত্মার মুক্তি রহস্য, প্রয়াণের পর আত্মার অবস্থানসহ আত্মার আত্মিক উন্নয়ন সাধনে সার্বিক তথ্য ও পরম্পরা জ্ঞান প্রত্যেকের নিজনিজ জ্ঞানগুরুর কাছ থেকে জেনে বুঝে নেয়া একান্ত কর্তব্য।
অথবা একজন আত্মতাত্ত্বিক দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন পাকা সাধকগুরুর সান্নিধ্য নিয়েই সকল মানুষের আত্মদর্শনের জ্ঞান আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।

তথ্যসুত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন»
  সম্পাদনা»  গবেষণা» 
 কালের লিখন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন