মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৬

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে ।। লালনবাণীর প্রকৃত পাঠ

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে,
আমরা ভেবে করব কী,
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম,
তাকে তোমরা বলো কী।

ছয়মাসের এককন্যা ছিল, 
নয়মাসে তার গর্ভ হলো, 
এগার মাসে তিন সন্তান হলো, 
কোনটা করবে ফকিরি।

ঘর আছে দুয়ার নাই,
মানুষ আছে তার কথা নাই,
কেবা তার আহার জোগায়, 
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি। 

লালন সাঁইজি ভেবে বলে, 
মাকে ছুঁলে মরে ছেলে,
এ তিন কথার অর্থ নইলে,
তার হয় না ফকিরি।

আত্মতত্ত্ব দেহতত্ত্বের প্রাণপুরুষ, সাধককুল শিরোমণি বাঙালি ভাষাভাষীদের জন্য মহান রূপকার, বাংলাভাষার মরমিকবি, আত্মতত্ত্বের জনক মহাত্মা লালন সাঁইজি।  মহান আধ্যাত্মিকজ্ঞানতাপস ও জীবন ঘনিষ্ঠ  আত্মতাত্ত্বিক দার্শনিক মহাত্মা লালন সাঁইজি একজন সুমহান রূপকার হিসেবে রুপকের অন্তরালে আত্মতত্ত্বের কথা বলে গেছেন তাঁর নির্মিত সকল বাণীতে, সাঁইজির বাণীর মূল শিক্ষা হলো- মানব জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য নিজেকে জানা অতি জরুরী, মানুষতত্ত্ব- শ্রেষ্ঠতত্ত্ব, ভাব নয় বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে মূলে ধাবিত করে। সাঁইজির প্রতিটি সহজ পদ আত্মদর্শনের অমিয় বাণী, এর তাল, লয়, ছন্দ, ভাব, ভাষা, শব্দের গাঁথুনি, উপমাশৈলী আর রুপকের অন্তরালে মূলকের আভাস, মোহিত করে অনুসন্ধিৎসু মন।
    মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, সাঁইদর্শন, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই সাঁইজির উদাত্ত কণ্ঠের আহব্বান- “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন, সত্য সুপথ না চিনলে, পাবি না মানুষের দরশন।”
    সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।

প্রথমে আমরা আলোচ্য বানীতে ব্যবহার করা হয়েছে এরকম কিছু শব্দের আভিধানিক ও দেহতাত্ত্বিক অর্থ বিন্যাস করবো, তারপর আলোচ্য বাণীর ভাবার্থ বিশ্লেষণ করবো-
আলোচ্য বানীর রূপক শব্দের অর্থ বিন্যাসঃ
চাঁদ, ঝি, মা, ছয়মাসের কন্যা, নয়মাসের গর্ভ, এগারো মাসের সন্তান, ফকিরি, ঘর আছে দুয়ার নাই, মাকে ছুঁয়ে ছেলে মরা।
চাঁদঃ  চন্দ্র, শশী, নিশাকর, প্রীতি উৎপাদনের বস্তু (চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা), বয়সের প্রতি সম্বোধন (চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে) অসুন্দর বা অবাঞ্ছিতব্যক্তি (চাঁদসুন্দর যায়) দেহতত্ত্বে চাঁদ হচ্ছে- দেহ, সাঁই, যৌবন, রজ, পবিত্রতা। চাঁদ আত্মদর্শনের একটি প্রত্যয় বিশেষ (গুরুচন্দ্র, যুগলচন্দ্র, দয়াল চাঁদ, গুরু চাঁদ) (চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী, ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলো কী- লালিত লালন) আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানে চাঁদ হচ্ছে- যৌবন, তারুন্য, তরুণকাল, যুবাকাল, দি পিরিওড ওফ ইয়থ, আইয়ামুশ শাবাব, চন্দ্রচেতনকাল, কামচেতনাপ্রাপ্ত বয়স। বাংলা দৈবিকায় চাঁদ হচ্ছে- ধনী, বণিক, সম্পদশালী। চাঁদের আরও কিছু অভিধা- জোয়ান, পুলসিরাত্ব, গনি, মালেনিসাব, ইয়াং, এ্যাডাল্ট। আত্মদর্শনের সংজ্ঞা- ১১ হতে ৪০ বছরের মধ্যবর্তী তারুণ্যতাকে যৌবন বা রূপকার্থে চাঁদ বলা হয়।
চাঁদের গায়ে চাঁদ লালাঃ কিশোরচাঁদের গায়ে যৌবনচাঁদ উদিত হওয়া, নারিচাঁদের ওপর সাঁইরূপ চাঁদ উদিত হওয়া, রজস্বলাদের পবিত্রতারূপ চাঁদের গায়ে রজরূপ চাঁদ উদিত হওয়া (চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী, ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলো কী- লালন)।
ছয়মাসের কন্যাঃ ছয় মাস বয়সের কন্যা সন্তান (ছয়মাসের এক কন্যা ছিল, নয়মাসে তার বিয়ে হলো, এগারমাসে তিনসন্তান হলো, কোনটা করবে ফকিরি- লালন) আত্মতত্ত্বে ছয়রিপু- ১.কাম ২.ক্রোধ ৩.লোভ ৪.মোহ ৫.মদ ও ৬.মাৎসর্য্য এ ছয়রিপুকে একত্রে ছয়মাসের কন্যা বলা হয়।
কন্যাঃ মেয়ে, তনয়া, দুহিতা, আত্মজা, সুতা, নন্দিনী, কুমারী, পাত্রী, বধূ, নববধূ, কুমারী মেয়ে, অবিবাহিতা নারী, বিবাহের উপযুক্তা নারী, ভাবীবধূ, বিবাহ অনুষ্ঠানের নায়িকা, কন্যারাশি, রাশি বিশেষের নাম।
ঝিঃ কন্যা, দুহিতা, মেয়ে, তনয়া, কুমারী, নন্দিনী, চাকরানি, দাসী, পরিচারিকা ১.(চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী, ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলো কী- লালন) ২.(জল থেকে হয় মাটির সৃষ্টি, জাল দিলে হয় গো মাটি, বুঝে দেখ এ কথাটি, ঝিয়ের পেটে মা জন্মায়- লালন) আত্মদর্শনে ঝি হচ্ছে- দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, জাসাদ, জিসম, বদন, কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, গাছ, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা।
রূপকসাহিত্যের একটি দৈবিকা বা প্রতীতি, জীবের স্থূল আকারকে দেহ বা রূপকার্থে ঝি বলা হয়। ঝি শব্দের আরও কিছু অভিধা- ওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্স, আলম, ক্ববর, গোর, জাহান, রথ, দেহ।
তিনসন্তানঃ তিনটি ধারা, তিনটি তার, তিনটি মাধ্যম ১.(এক মেয়ের নাম কলাবতী, নয় মাসে হয় গর্ভবতী, এগারমাসে সন্তান তিনটি, মেজটা তার ফকির হয়- লালন) ২.(ছয়মাসের এককন্যা ছিল, নয়মাসে তার গর্ভ হলো, এগারমাসে তিন সন্তান হলো, কোনটা করবে ফকিরি- লালন) ৩.(মরা যখন কবরে নেয়, তিনটি সন্তান জন্ম হয়, তিনজনা তিনদেশে যায়, মরা লাশ ফেলে দিয়ে- লালন)। দেহতত্বে- ১.শুক্র, ২.সুধা ও ৩.মধু- এ তিনটি ধারাকেই তিনটি সন্তান বলা হয়।
সন্তানঃ সন্ততি, অপত্য, বংশধর, ফল, বংশ, গোত্র, ধারা, প্রবাহ, ব্যাপ্তি, বিস্তার।
নয়মাসে গর্ভ হওয়াঃ নয় মাসের মধ্যে গর্ভ সঞ্চারিত হওয়া ১.(এক মেয়ের নাম কলাবতী, নয়মাসে হয় গর্ভবতী, এগারমাসে সন্তান তিনটি, মেজটা তার ফকির হয়- লালন) ২.(ছয়মাসের এককন্যা ছিল, নয়মাসে তার গর্ভ হলো, এগারমাসে তিনটি সন্তান, কোনটাতে হয় ফকিরি- লালন)। মানবদেহের নয়টি দ্বার- দুই চোখ, দুই কর্ণ, নাসিকার দুই ছিদ্র, মুখ, জলদ্বার ও মলদ্বার- মানবদেহের এ নয়টি দ্বার বা ১.চোখ, ২.কান, ৩.নাক, ৪.মুখ, ৫.মল, ৬.মূত্র, ৭.রতী, ৮.রজ ও ৯.সাঁই- মানবদেহের এ নয়টি দ্বার। রূপকসাহিত্যে মানবদেহের নয়টি দ্বার সক্রিয় হওয়াকে গর্ভ হওয়া বলা হয়।
গর্ভঃ ভিতর, মধ্য, তলদেশ, উদর, জঠর, জরায়ু, গর্ভাশয়, ভ্রুণ, জঠরস্থ সন্তান, অন্তসত্তা অবস্থা। ঢাকা, নিধুয়া, মথুরা, কাশী, বৈকুণ্ঠ, স্বর্গ, নিধুয়া, গর্ভাশয়।
এগারমাসঃ এগারটি মাস, এগারতম মাস, ১১ স্ত্রী, ১১ গিন্নি। দেহতত্ত্বে- নয়টি প্রকাশ্যদ্বার, শুক্রদ্বাররূপ গুপ্তদ্বার ও রজদ্বাররূপ গুপ্তদ্বার- এ মোট ১১টি দ্বারকে রূপকসাহিত্যে এগারমাস বলা হয়। ১.(এক মেয়ের নাম কলাবতী, নয়মাসে হয় গর্ভবতী, এগারমাসে সন্তান তিনটি, মেজটা তার ফকির হয়- লালন) ২.(ছয়মাসের এক কন্যা ছিল, নয়মাসে তার বিয়ে হলো, এগারমাসে তিনসন্তান হলো, কোনটা করবে ফকিরি- লালন)। এগারটি দ্বার, এগাররুদ্র, দুই চোখ, দুই কর্ণ, নাসিকার দুইটি ছিদ্র, মুখ, জলদ্বার মলদ্বার শুক্রদ্বার ও রজদ্বার- মানবদেহের এ এগারটি দ্বার {বাং.এগার+ বাং.মাস}
ফকিরিঃ বিদ্যাচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা, দার্শনচর্চা, বুদ্ধিবত্তা। মরমিসাধনার কলাকৌশল, আধ্যাত্মিকসাধনার পদ্ধতি (কেউ রাজা কেউ বাদশাগিরি, ছেড়ে কেউ করে ফকিরি, আমি এ নিমাই কী ছার নিমাই, কী ধন ছেড়ে বেহাল পরেছি গায়-লালন)
মাঃ মাতা, জননী, গর্ভধারিণী, মাতৃস্থানীয়া নারির প্রতি সম্বোধন, কন্যা বা কন্যাস্থানীয়া নারির প্রতি সম্বোধন।  বিস্ময়, ভয়, আতংক (ওমা)। স্বরগ্রামের মধ্যম বা চতুর্থ সুর। জগম্ময়ী, জগম্মাতা, বিশ্বমোহনকারিণী, ভুবনময়ী, ভুবনমোহিনী, বিশ্বজননী আদ্যাশক্তি, কালী, পৃথিবীর মাতা, সর্বব্যাপিনী ও সর্বত্র বিরাজিতশক্তি (নিগূঢ় বিচারে সত্য তাই গেল জানা, মায়েরে ভজলে হয় বাপের ঠিকানা- লালন)। দেহতত্বে- শুক্র, বীর্য, বিন্দু, রতী, সিমেন, মনিউ, নুত্বফা, রুজুলাত। গোবিন্দ, অহল্যা, কালী, জল, বারি, দুর্গা, পিতৃধন, বৈষ্ণবী, সীতা, আদম, ওয্যা, জিন,পরী, বিলকিস, যাকাত, জুলেখা, লুত্ব। শুক্র পরিবারের সদস্য বিশেষ, রূপকসাহিত্যের একটি দৈবিকা বা প্রতীতি। কামব্রতের সময়ে শিশ্ন হতে নিঃসৃত শুভ্রবর্ণের তরল পদার্থকে শুক্র বা রূপকার্থে মা বলা হয়। আঙ্গুর, খেজুর, রুটি, ফল, কমলা, বেহুলা, রতী, সীতা,ধন, শুক্র।
মাকে ছুঁয়ে ছেলে মরাঃ রূপকসাহিত্যে শুক্রকে মা, শিশ্নকে ছেলে এবং শুক্রপাতকে মরণ বলা হয়। কামব্রত পালনে গিয়ে শিশ্ন যদি শুক্ররূপ মাতাকে স্পর্শ করে অর্থাৎ শুক্রপাত করে তবে মারা যায়। রূপকসাহিত্যে তাই বলা হয় মাকে ছুঁলে ছেলে মরে।  ১.(মাকে ছুঁলে পুত্রের মরণ, জীবগণে তাই করে ধারণ, ভেবে কয় ফকির লালন, হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গবার নয়- লালন) ২.(লালন সাঁইজি ভেবে বলে, মাকে ছুঁলে মরে ছেলে, এ তিন কথার অর্থ নইলে, তার হবে না ফকিরি- লালন)।


আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণঃ

আত্মতত্ত্বের আলোকে যদি আমরা বানীটির স্বরূপ উদঘাটন করতে যাই দেখবো আলোচ্য বানীতে সাঁইজি মানবজীবনের সেই সময়টার দিকে আলোকপাত করেছেন, যখন একজন মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়।  মানুষের মনের চারটি অবস্থা- অবচেতন, অচেতন, চেতন ও সচেতন।  যৌবনপ্রাপ্ত হবার পরেই সাধারণত মানুষের অচেতন মন চেতন প্রাপ্ত হয়। অধিকাংশ মানুষের মনই এই চেতন পর্যায়ে থেকে যায় সারাজীবন। যখন একজন মানুষ দিব্যজ্ঞানী কোন গুরুর কাছে আত্মদর্শন জ্ঞান লাভ করেন, অধ্যয়ন করেন দেহনামক বিশ্ববিদ্যালয়, তখনি তার মন চেতন থেকে সচেতন হয়। সাধারণ মানুষ দুই পায়ে চলে, দিব্যজ্ঞানী সাধুরা ছয় পায়ে চলে। দেহতত্ব পাঠের সাথে সাথে নাসিকার দুই শ্বাস আর মন জ্ঞান তার নিত্যদিনের চলার সাথী হয়ে যায়। 
চেতন মন থেকে সচেতনে পৌঁছার ক্রিয়া হিসেবে লালন সাঁইজির উচ্চারণ-

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করবো কী,
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম
তাকে তোমরা বলো কী।

আত্মদর্শনে চাঁদ একটা প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহার হয়, মানে শব্দের মাধুর্য বা দ্যোতনা বৃদ্ধি করে, যেমন- দয়াল চাঁদ, নিতাই চাঁদ, গুরু চাঁদ, কিম্বা চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। দেহতত্ত্বীয় মূলকগুলোর অশ্লীলতা পরিহার করার জন্য আত্মতাত্ত্বিক রুপকারগন নতুন নতুন রূপক শব্দ নির্মাণ করে থাকেন। অনেকটা মূল জিনিসটাকে রুপকের আচ্ছাদনে মুড়িয়ে দেয়া যাতে অশ্লীলতা পরিহার হয় এবং মানুষের জানার ইচ্ছেটা বেশি করে জাগ্রত হয়। সাঁইজি আলোচ্য বানীতে চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা বলতে বুঝাচ্ছেন- কিশোরচাঁদের গায়ে যৌবনচাঁদ উদিত হওয়া। রজস্বলাদের পবিত্রতারূপ চাঁদের গায়ে রজরূপ চাঁদ উদিত হওয়া। সহজ কথায় কিশোর বা কিশোরীদেহ যখন যৌবন প্রাপ্ত হয় তখনি চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগে, অর্থাৎ কিশোর চাঁদের গায়ে যৌবন চাঁদের উদয় হয়। কিশোরচাঁদের গায়ে যৌবনচাঁদ উদিত সওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেহরূপ ঝিয়ের অভ্যন্তরে শুক্ররূপ মায়ের উদয় বা অভ্যুদয় হয়ে থাকে। (আত্মতত্ত্বে দেহকে ঝি আর শুক্র কে মা বলা হয়) আর এ কথা আমরা সবাই জানি যে- কোন কিশোর যুবক না হওয়া পর্যন্ত তার দেহে শুক্র উৎপন্ন হয় না। এজন্যই সাঁইজি আগে চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার কথা বলে, পরে ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্মের কথা বলেছেন। মহাত্মা লালন সাঁইজি একজন রুপকার হিসেবে এখানে ঘোষণা করেছেন যৌবনের জয়গান।

ছয়মাসের এককন্যা ছিল,
নয়মাসে তার গর্ভ হলো,
এগারমাসে তিন সন্তান হলো,
কোনটা করবে ফকিরি।


আত্মদর্শনে কিছু মূলকসংখ্যা আছে যেমন- 
১. নিরীক্ষ = ১.নিরীক্ষ।
২. ফল = ১.সাঁই ও ২.স্রস্টা। 
৩. তার = ১.ইড়া, ২.পিঙ্গলা ও ৩.সুষুম্না ।
৪. চারচন্দ্র = ১.সরলচন্দ্র ২.গরলচন্দ্র ৩.রোহিণীচন্দ্র ও ৪.মোহিনীচন্দ্র। 
৫. পঞ্চবাণ = ১.মোহন, ২.মাদন, ৩.তাপন, ৪.শোষণ ও ৫.স্তম্ভন। 
৬. ছয়রিপু = ১.কাম, ২.ক্রোধ, ৩.লোভ, ৪.মোহ, ৫.মদ ও ৬.মাৎসর্য্য। 
৭. সপ্তকর্ম = ১.দর্শন, ২.শ্রবণ, ৩.শ্বসন, ৪.বলন, ৫.মৌনতা, ৬.বিজ্ঞতা ও ৭.নিষ্কামিতা। 
৮. অঙ্গ = ১.নিরীক্ষ, ২.নয়ন, ৩.মন, ৪.জ্ঞান, ৫.হস্ত, ৬.পদ, ৭.শ্বাস ও শিশ্ন। 
৯. নয়দ্বার = ১.দর্শনদ্বার, ২.কর্ণদ্বার, ৩.শ্বাসদ্বার, ৪.অন্নদ্বার, ৫.মলদ্বার, ৬.জলদ্বার, ৭.শুক্রদ্বার, ৮.রজদ্বার ও ৯.সাঁইদ্বার। 
১০. ইন্দ্র = ১.চক্ষু, ২.কর্ণ, ৩.নাসিকা, ৪.জিহবা, ৫.ত্বক, ৬.বাক্, ৭.পাণি, ৮.পাদ, ৯.পায়ু ও ১০.উপস্থ। 

এগুলোকে সংক্ষেপে এরকম বলা হয়- ১.একনিরীক্ষ, ২.দুইফল, ৩.তিনতার, ৪.চারচন্দ্র, ৫.পঞ্চবাণ, ৬.ছয়রিপু, ৭.সাতকর্ম, ৮.অষ্টাঙ্গ, ৯.নয়দ্বার, ১০.দশইন্দ্র, ১১.এগাররুদ্র, ১২.বারোনেতা, ১৩.তেরনদী, ১৪.চৌদ্দপোয়া, ১৫.পনেরচল, ১৬.ষোলকলা, ১৭.আঠারোধাম, ১৮.ঊনিশরক্ষী, ১৯.বিশাঙুল, ২০.একুশদিন, ২১.তেইশজোড়া, ২২.চব্বিশপক্ষ।
এসব মূলক সংখ্যা কে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা রুপক ভাবে প্রকাশ করে থাকেন, যেমন- ছয় রিপু কে বলেনঃ ছয় ডাকাত, ছয় মাসের কন্যা, ছয়জন মাঝি, ছয় চোর, ছয় পাগল, ছয় দস্যু ইত্যাদি, আত্মতত্ত্বের রূপক বানীতে যতরকম ছয় থাকবে, বুঝতে হবে এখানে মানব মনের ছয় রিপুর কথা বলা হচ্ছে। ঠিক তেমনি ভাবে নয়মাসের গর্ভ মানে ৯ টা দ্বার উন্মুক্ত হওয়া, এগারমাস হলো এগার রুদ্র, আর তিন সন্তান হলো- লাল সাদা ও কালো ধারা। চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগলে অর্থাৎ যৌবন উদয় হলেই নারী দেহে সাদা কালো ও লাল ধারা চালু হয়। অন্যদিকে দেহতত্বে- ১.শুক্র, ২.সুধা ও ৩.মধু- এ তিনটি ধারাকেও তিনটি সন্তান বলা হয়। যা উৎপন্ন হয় চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরেই, অর্থাৎ যৌবনপ্রাপ্ত হলেই।


ঘর আছে দুয়ার নাই,
মানুষ আছে তার কথা নাই,
কেবা তার আহার জোগায়,
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি।


এখানে ঘর বলতে মাতৃ জঠর বা গর্ভাশয় বুঝানো হচ্ছে, মায়ের গর্ভ এরকম একটা ঘর যেই ঘরে দুয়ার নাই, জানালা নাই, সেখানে মানুষ আছে কিন্তু সেই মানুষের কোন বাক্য নাই। সেই ঘরে দিন নাই রাত নাই, নাই আহার বিহার বা সন্ধ্যাবাতির ব্যবস্থা। চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরে যখন একজন মানুষ পুনর্জন্মে যায়- তখনি এই অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে।


লালন সাঁইজি ভেবে বলে,
মাকে ছুঁলে মরে ছেলে,
এ তিন কথার অর্থ নইলে,
তার হয় না ফকিরি।


আমরা প্রথমের জেনেছি- চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরপরই ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম হয়।  আত্মদর্শনে দেহকে ঝি এবং শুক্রকে মা ধরা হয়। দেহের মধ্যে শুক্রর সৃষ্টি হওয়াকে রূপকার্থে ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম বলা হয়। শুক্রই মা এবং দেহই যে ঝি তার প্রমাণস্বরূপ সাঁইজির উপস্থাপন- “লালন ফকির ভেবে বলে, মাকে ছুঁলে মরে ছেলে, এসব কথার অর্থ নইলে, তার হয় না ফকিরি”। এখানে ছেলে হলো শিশ্ন এবং মা হলো শুক্র। অর্থাৎ দেহরূপ ঝিয়ের ক্ষেত্রেও যেরূপ মা হলো ‘শুক্র’ তদ্রপ শিশ্নরূপ ছেলের ক্ষেত্রেও মা হলো ‘শুক্র’। অতএব এবার সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় কবির মনোকল্পে নির্মিত ঝি হলো অবশ্যই নরদেহ এবং মা হলো অবশ্যই শুক্র। শিশ্নরুপ ছেলে যখন মা রুপ শুক্র কে স্পর্শ করে তখনি তার মৃত্যু ঘটে, শুক্রপাত মানে মৃত্যু। আত্মদর্শনে প্রয়াণ হচ্ছে জীবের দেহাবসান, অন্যদিকে মৃত্যু মানেই কামযজ্ঞে গিয়ে শুক্রপাতরুপ মৃত্যুবরণ করা। যখন একজন মানুষ শুক্রপাত বন্ধ করে লাল সাদা ও কালো ধারার সন্ধান পাবে, বন্ধ করতে পারবে নিজের জন্ম মৃত্যু, সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে তিন কথার অর্থ সেই ফকির হবে, সেই সাধক হবে।
মহাত্মা লালন সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, ছন্দোবদ্ধ গানের আড়ালে বর্ণনা করে গেছেন অপূর্ব এক মানবদর্শন। যে দর্শন সর্বকালে সর্বযুগে সকল মানুষের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য। সাঁইজি বারবার তার বানীতে নিজেকে চিনে নেওয়ার কথা বলেছেন, বলেছেন- দেহ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নের কথা। আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরপরই প্রত্যেকের উচিৎ আত্মদর্শন জ্ঞান লাভ করা। ধর্ম জাতপাত যার যার, আত্মদর্শন সবার।

তথ্যসূত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন সম্পাদনা ও গবেষণাঃ কালের লিখন

সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি-
@ কালের লিখন- কবি, লেখক, গীতিকার, পুঁথিকার, শিশু সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, আত্মতাত্ত্বিক দার্শনিক, লোকসাহিত্য ও লালন গবেষক।

রবিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৬

প্রসব সংক্রান্ত ।। কালের লিখন

অভিমানে বাঁকা হয়ে যাই,
রাগে ক্ষোভে দিক নাহি পাই-
অক্ষম আক্রোশে ভাবনা পোড়াই।

হতাশায় আন্ধার দেখি চোখে,
না কাটা দাড়ির ঝোপ মুখে-
নিরলে মরি- মৌলিক দুঃখে।

বেদনায় নাড়া খায় অনুভব,
বুঝিনা বলে লোকে কি সব-
নিজস্ব বিষাদ পুড়ে কাব্য প্রসব।

কবিতার ডাক নাম ধাবমান,
কবিতার বিষয় সমস্ত দিনমান-
কবিতার ভার মনের সমান।

আশাবাদে বেঁধে রাখি বুক-
যেন জগত এক আনন্দের মুখ,
চারপাশে মিঠে রোদ, নেই শোক।

বৃক্ষসব প্রাণদায়ী মায়াময় ছায়া;
একটা মানুষও আর নাই বেহায়া-
চারপাশে চলমান ছায়াময় মায়া।

চোখে খুলে দেখি সূর্যের হাসি;
মানুষের কাজ ভালোবাসা বাসি-
গভীর প্রত্যয় নিয়ে লিখতে বসি।

কবিতার নাম হয় মানুষঘেঁষা;
কবিতার ভিত প্রাচুর্যে ঠাসা-
কবিতার ক্রিয়া ভাব ভালোবাসা।

শনিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৬

মৌলিক গান ।। কালের লিখন

যে আমাকে বুঝতে পারলো না,
যে পারলো না উন্মোচন করতে
আমাদের নিজস্ব কথামালা।
যে সাজাতে ভয় পেলো প্রণয় ডালা,
সে প্রেমী নয়, তার কাছে সবই খেলা।

যে আমাকে চিনতে ব্যর্থ হলো,
যে শিখলো না পাখার ভারসাম্য
জমিনে বসে করলো আকাশযাপন।
যে লাভে লোভে মগ্ন সারাক্ষণ,
সে না মানুষ, মিথ্যে তার প্রেমায়োজন।

যে আমাকে জানতে সচেষ্ট নয়
যে জানে না অজানার গভীরতা
কোথায় ছুঁয়ে আছে অলীক ব্যবধান।
যে বিশ্বাস করে শুধুই আদান-প্রদান
সে বন্ধু নয়, নকল সুরের যৌগিক গান।

যে আমাকে আমি মনে করলো না-
সে আসলে আমার নয়, আমিও তার না।

জানুয়ারি- ২০১৬

বুধবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৬

কবি নয়, কবিতা অমর ● কালের লিখন

যেদিন রবীন্দ্রনাথ মরে গেলেন
সেদিনও পৃথিবী ঘুরছিলো।
নিউটনের মৃত্যু দিনেও অবিকল-
বাতাসে কবিতার স্বর ছিলো।
যেদিন মরে গেলেন কবি নজরুল-
বাগানে তখনো ফুটেছে সন্ধ্যা ফুল।
মরে গেলেন যেদিন, জয়নুল আবেদিন-
আবর্তনে মগ্ন ছিলো তখনো রাতদিন।
কবি বিজ্ঞানী শিল্পী, কিম্বা যারা মহৎ-
স্ব-মহিমায় এঁকে গেছেন, কালান্তরের পথ।
আমিও যেদিন মরে যাবো জানি,
সেদিনও বাজবে সুরের বীণা খানি।
বাজবে সেদিনও অন্য কবির শব্দ স্বর-
আমি তো জানি কবি নয়, কবিতা অমর।

গাছ পাখি ও মানব সমীকরণ ● কালের লিখন

মানুষ মাত্রই পাখিজীবন প্রত্যাশী-
পাখির বোধে নাই মানুষ হবার তাড়না।
নিশ্চয় সৌভাগ্য সেই পাখিটার-
যে জানলো না- মানুষের এক জীবন,
নিজস্ব দুঃখ আর বিষাদ সামাল দিতে দিতেই শেষ হয়ে যায়।

দাঁড়িয়ে থাকার অবস্বাদ মেখে,
পরগাছা গায়ে জড়িয়ে, নুয়ে আছে যে গাছটা।
তৃতীয় চোখের ইশারায় তার পত্র বদল হয়,
বাইরে দাঁড়িয়ে স্থাণু বৃক্ষ জানতে পারে না-
মানুষের এক জীবন ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই উধাও হয়ে যায়।

জানুয়ারি- ২০১৬

রবিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৬

নির্বাসিত জলগুচ্ছ​ ● কালের লিখন

সকালের মিঠে রোদ লেগে মরে গেছে যে টলমলো শিশির বিন্দু,
আমি সেই শিশিরের বুকেই লিখে দিয়েছি অমরত্বের শ্লোগান।
হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় যে মা-
আমি সেই মায়ের চোখেই দেখেছি জগতের সমূহ প্রাপ্তি আর সহিষ্ণুতা।

জীবন গল্পের প্রারম্ভিক পাঠ অসমাপ্ত রেখে, যে স্কুলঘর
অকালের ঝড়ে ঝরে পড়েছে, আমি তার দেয়ালেই লিখে রেখেছি-
'জীবনের পাঠ দেয়াল বা বইয়ে নয়, খেয়ালে থাকে'।

যে জল আকাশের প্রেমে মগ্ন হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে ক্লান্তিহীন-
মানুষ তাকে মেঘ নামে ডাকলেও, আকাশের দৃষ্টিতে সে নির্বাসিত জলগুচ্ছ।

জানুয়ারি- ২০১৬

বেকার ● কালের লিখন

দু'টাকায় বাদাম পাওয়া যায় না,
পাঁচ টাকার ঝালমুড়িও হয় না।
দশ টাকার শিক্ষা কিনে- ইশকুলে,
আছি পেট বুঝাই বিদ্যে নিয়ে মুশকিলে।
আমি এই বাংলাদেশের বেকার-
বেঁচে থাকা মূল্যহীন, মূল্য শুধু টাকার।

জানুয়ারি- ২০১৬

সোমবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৬

প্রাত্যহিক

আমাদের সন্তাপের নাম আচ্ছাদন-
আমাদের অনুভবে ভগ্ন বিভাজন।
আমাদের বিষাদ এখনো উপভোগ্য-
লাভ লোভে সীমাবদ্ধ অবলা অযোগ্য।

যারা থেমে আছে বহুদিন চেনাপথে-
যারা ঘেমে আছে রোদহীন কথঘাতে
যারা নেমে গেছে মাঝপথে ট্রেন থেকে-
এখনো ভ্রমণে তারা, পায়নি নিজেকে।

সকালের নিত্যাভ্যাসে সূর্য উঠে রোজ-
এছাড়া কে রাখে? সমস্ত দিনের খোঁজ।
জানুয়ারি- ২০১৬

রবিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৬

নিশ্চয়তা

একদিন নিশ্চিত মরে যাবো জেনেই বেঁচে আছি-
বহুদূরে সরে যাবো ভেবেই তো এত কাছাকাছি।
যাবো বলেই এসেছি আজ তুমিও এবার এসো-
বিষণ্ণ থেকো সারা জীবন এবার না হয় হাসো।

জানুয়ারি- ২০১৬

কালের লিখন এর একগুচ্ছ- ●বিযুক্ত বিম্ব●

বিযুক্ত বিম্ব-০১
বিপন্ন বিস্ময় বিজাতীয় বিভাজন,
বিচ্ছিন্ন বিধিলিপি বিমুগ্ধতা বিরল।
বিষাদ বিলঙ্ঘনীয় বিস্তৃতি বিলক্ষণ,
বিরহী বিরুদ্ধতা বিনয়মূলে বিমল।

বিযুক্ত বিম্ব-০২
বিশ্বাসে বিঘ্নিত বিরল বিমোহন,
বিলাসে বিবাদী বিমূঢ় বিছানা।
বিপর্যস্ত বিপর্যয় বিফল বিবর্ধন,
বিবিধ বিভক্তি বিব্রত বিবেচনা।

বিযুক্ত বিম্ব-০৩
বিদায়ী বিষাদে বিতৃষ্ণ বিভাকর,
বিবেচ্য বিবর্তনে বিভাজ্য বিভ্রম।
বিমতে বিভ্রাটে বিভিন্ন বিষধর-
বিমর্দ বিভূতি বিশ্বাসঘাতী বিষম।

বিযুক্ত বিম্ব-০৪
বিবেচক বিবেকে বিষাক্ত বিষয়সূচি,
বিষচক্ষে বিষণ্ণা বিসঙ্গত বিষ্ণুপ্রিয়া।
বিশ্লেষিত বিশ্বকোষ বিশোধকের বিচি-
বিশ্বমিত্র বিশ্বব্যাপী বিলুপ্ত বিষক্রিয়া।

বিযুক্ত বিম্ব-০৫
বিচক্ষন বিচারকর্তা বিঘ্ননাশক বিঁধি,
বিক্ষত বিচয়নে বিচিত্রিত বিজ্ঞপ্তি।
বিদায়ী বিড়ম্বনায় বিদূষক বিদ্যানিধি,
বিধুবদন বিধায়ক বিনীত বিজেত্রী।

শুক্রবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৬

কথার কদর ● কালের লিখন​

কিছু ফালতু লোক, নীতিকথা
আওড়াতে আওড়াতে মূলকথা ভুলে কানা বক।
ভুল কথার পরিমাপ মাপতে মাপতে
পথেই মরে গেলো তিন হাজার ইতিহাস লেখক।
কটু কথার ভার নিতে না পেরে
নদীর মতো যুবতী বোনটা গলায় দড়ি দিলো।
সমুদ্রের মতো সুবিশাল অনুভূতি নিয়ে
কথা খুঁজে না পাওয়া লোকটা কবি হয়ে গেলো।

তারপর?
ভাবে মগ্ন পৃথিবীতে, স্থায়ী হলো কথার কদর।

জানুয়ারি- ২০১৬

বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৬

পুরনো চৌকাঠ

আমার দৃষ্টির নাম উধাও আকাশ,
চোখের নাম সবুজ মাঠ।
আজকাল মনের নাম সমুদ্র আমার-
ভুলের নাম ফুলের খামার।
অথচ একদিন আমার সীমানার
নাম ছিলো পুরনো চৌকাঠ।

জানুয়ারি- ২০১৬

বয়সী নীরবতা ● কালের লিখন​

এক মুঠো ঘাসের স্বপ্ন বুকে নিয়ে
মরে গেছে যে মাঠ। সেই মৃত মাঠের বুকে
অমৃত জীবনের চাষাবাদ করে নাগরিক ফড়িং।
যদিও চলমান সভ্যতা দিনমান ধুঁকে-
একথা সবাই জানে, ঘুম পায় না স্বপ্নকে।

দৃষ্টি পায়না স্বচ্ছতার সীমারেখা-
অথৈ জল ধারনের স্বপ্ন বুকে ধরে
মরে যাওয়া নদীর কাছে এই পাঠ্য নিয়ে
হাঁটুজল পেরিয়ে পাঠশালায় যায় কানা বক।

মনোযোগী ছাত্রের অভাবে বিষাদাক্রান্ত
যে শিক্ষক মৌলিকত্ব হারিয়ে মৃতপ্রায়-
তিনি এখন বিজ্ঞাপন নির্মাতা। আর সব?

আধুনিক কলরবে ক্রমশ সুপ্রাচীন কোলাহলও নীরব।

জানুয়ারি- ২০১৬

বিচিত্র চিত্রা- ০১ ● কালের লিখন​

ভালোবাসা সহজ কিছু নয় চিত্রা-
ভীষণ জটিল এর শিরা উপশিরা।
দুরন্ত কুটিল এর অধিকারের মাত্রা-
হিসেবে গোলমাল হলেই দিশেহারা।

চিত্রা- এসো বিচিত্র এই পৃথিবীতে-
কাছাকাছি থাকি কুয়াশাঘন শীতে।

জানুয়ারি- ২০১৬

স ন্তা প ● কালের লিখন​

মা মরে গেছে বাবাও নেই, নাই ভাই বোন,
কোন ঠিকানা নাই, নাই কোন স্থায়ী গৃহকোণ।
সবকটা বাল্য বন্ধু অন্ধ হয়ে গেছে তাপে-
পড়শিরা সব মরে গেছে অজানা সন্তাপে।

শুধু গাছগুলো এখনো দেখতে সবুজ, তাই-
কালো অক্ষরে লাল বেদনার কাব্য লিখে যাই।

জানুয়ারি- ২০১৬

ম ন স্তা প ● কালের লিখন​

যখন তোমার সাথে প্রথম দেখা,
সাররাত চমৎকার ঘুমের পর
একটা ফুরফুরে স্নিগ্ধ, মুগ্ধ সকাল।
টগবগ করে ফুটছে তখন কথার খই।
যেন আমরা পরস্পর কত চেনা,
চিরকালীন অন্ধকারের আলোকিত সই।

একটা মস্ত আকাশ চোখের সামনে
বিছিয়ে দিয়ে, আমরা সবুজ ঘাসের উপর
মুখোমুখি বসলাম, অকারণেই হাসলাম।
অসীম কৌতূহল ততক্ষণে সসীম শূন্যে,
কেবলই মনে হচ্ছে- আমরা পরস্পরের জন্যে।

ব্লুটুথের মতো মুহূর্তে শেয়ার হলো ভাব,
উদাস বাতাসে উড়ে বায়বীয় মনস্তাপ।
রোদের উষ্ণতায় চার্জ হলো আমাদের মন।
মনে আছে সেদিন রোববার ছিলো,
প্রমিজ আর প্রতিজ্ঞায় ভরে গিয়েছিলো-
প্রেম রসে পরিপূর্ণ শান্তশিষ্ট লন।

দুপুরের উপুড় করা সূর্যের আলোয়,
মন্দে ভালোয় মিলেমিশে আমরা দু'জন,
বহুদিন প্রতীক্ষায় ছিলাম, শুনবো বলে
সান্ধ্য পাখির একান্ত কূজন। তারপর
যতবার রাত নেমেছে, আমরাও নেমে গেছি
অন্ধকার থেকে আরও তীব্র অন্ধকারে।

পাশাপাশি দুই চোখ,
কেউ কাউকে কোনদিন দেখে নাই ফিরে।

জানুয়ারি- ২০১৬

ঘুমজনিত অজ্ঞতা ● কালের লিখন​

দিনের সাথে দেখা হবে বলেই-
দীর্ঘক্ষণ জেগে আছে রাত।
আজকাল রাতেরও ঘুম নাই।

রাত ঘুমায় না বলতেই দেখি-
ইটকাঠের মর্মর এই শহরেও
চারপাশে জোনাকের মিছিল
সোডিয়াম বাতিগুলোও জেগে আছে।

শুধু কিছু চিরকালীন অন্ধকার-
ঝুলে আছে বয়সী গাছে।

হাস্যকর সত্য হলো-
ঘুমজনিত অজ্ঞতার অভিকর্ষে
রাতকে জাগিয়ে রেখে, আমিই ঘুমিয়ে যাই।

জানুয়ারি- ২০১৬

কবির মৃত্যু ● কালের লিখন​

আমার অতি প্রিয় এক কবির কবিতায়
হাজার হাজার লাইক, কোটি কোটি মন্তব্য।
কিলবিল করে চলছে পাঠক- পায়ে পায়।
কবির কাব্য নিয়ে সবার- অসীমে গন্তব্য।

কবি যেন রাণী মৌমাছি- অজস্র ভক্তকূল-
কবির প্রোফাইল ছবিতে আছে ৮০টা ফুল।

অধীর আগ্রহে প্রতিদিন আমি মন্তব্য লিখি-
নিশ্চিত জানি কবির এসবে নেই কোন মন।
কবি মগ্ন শব্দের দ্যোতনায়, লগ্ন আঁকাআঁকি-
ভার্চুয়াল জগত তার অপ্রকাশ্য বিনোদন।

১০০ বছরের ঘুম ভেঙ্গে দেখি এক সকালে-
আমার মন্তব্যে লাইক দিয়ে কবি মরেছে অকালে।

জানুয়ারি- ২০১৬

আ গু ন ● কালের লিখন

গতবছর আগুন লেগে যে পাড়াটা পুড়ে গেছে,
সে পাড়ায় আমার সর্বশেষ প্রেমিকা থাকতো।
আজকাল আগুন লাগলেই- টিভি ক্যামেরা আসে,
আগের দিনে মগ বালতি হাতে প্রতিবেশী আসতো।

আজকাল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা মানেই পাসওয়ার্ড,
আর আগুন মানেই- সম্মিলিত নির্বাক দহন পদ্ধতি।
অক্টোবর- ২০১৫

অ স্ত কা লী ন ● কালের লিখন​


হোঁচট খাবার আগে ঠিকঠাক দাঁড়িয়েই যায়
পা। থমকে দাঁড়ায় চলন্ত গতিধারা!
শুয়ে থাকা পথ অবাক বিস্ময়ে ভাবে-
পথিকের জন্মকালীন গল্প তার বুকেই লেখা।
তারপরও মৃত মানুষের জন্মদিনে
ধৃত কিছু ধূর্ত মানুষ, অযথা বেলুন ফুটায়।

কুয়াশা ও ধোঁয়ার পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে
আমরা দিব্যি ভুলে যাই জলীয়বাষ্পের জলজ
ঘ্রাণ। গান যখন কলতান, কথা যবে বক্তৃতা,
অক্ষর যখন সাক্ষরহীন, কাব্য যখন নাব্যতা ভুলেছে,
ভবিতব্যের পায়ে স্থিতির কুঠার ঠুকে, আমরা
তখনো কাটতে থাকি সময়ের রক্তাক্ত শরীর।
চারপাশে কালো হাত, দৃশ্যপটটা ফাঁকা, একাকীত্বের ভিড়।

দিনের শেষে আক্লেশে জড়িয়ে ধরে বিদায়ী সূর্য-
নিভে আসে ধীরে ধীরে আলোকিত জীবনের আরাধ্য প্রাচুর্য।

জানুয়ারি- ২০১৬

অ নি র্ণী ত ● কালের লিখন​

অন্ধ লোকটা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে
একটা স্বচ্ছ আয়না হাতে নিয়ে।
বিকট শব্দে বোমা ফাটার পরে, বধির
লোকটা অধীর আগ্রহ নিয়ে হাসছে।

যে লোকটা কথা বলতে পারে না,
তার হাতেই এখন সমস্ত ভাষণযন্ত্র।
'সুস্থ বোধ ছাড়া পাগল হওয়া যায়না'
এই তথ্য প্রতিটি পাগলের জামাহীন বুকপকেটে।

পা ছাড়া মানুষগুলো এখনো উঁচু দালানে থাকে-
যাদের এখনো দুই'পা সম্বল- তারাই সময়ের ছবি আঁকে।

জানুয়ারি- ২০১৬

শুক্রবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৬

আশ্রয়

তরল জল যেভাবে ফ্রিজিং হয়- জমতে জমতে জমাটবরফ। সেভাবে নিতান্তই জমে যাবার মতো করে, ধীরে ধীরে ভারি হয়েছে তোমার ব্যক্তিগত দুঃখের সাতকাহন। আকাশকে বললে- নিবে কিছু? আকাশ মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো। চেনা আকাশের অচেনা প্রপঞ্চনা বুকে ধারণ করে- মগ্নমনে লগ্নভুলে, উদাস বিকেলে হেঁটে হেঁটে হাজির হলে, অভিমানী এক নদীর কাছে। বললে- হে শান্ত নদী নিবে কিছু অশান্ত দুঃখ আমার? নদীর শুকিয়ে যাওয়া জলও কেমন অশ্রুর মতো ছলছল করে উঠলো হঠাৎ। জলদায়ী নদীর একান্ত বিষাদ সাথে নিয়ে ভাবলে এবার সমুদ্রে যাই তবে- বিশাল সমুদ্রের ফেনিল জলে ফেলে আসি আমার দুঃখের ভার, কোন এক মরা সন্ধ্যায়, লোনা জলের প্রাচুর্য জিভে ছুঁয়ে তুমি আবিস্কার করলে- বারোয়ারী মানুষের দুঃখ আর চোখের জলে সমুদ্র ভারাক্রান্ত। ভাবতে ভাবতে অসীম মহাশূন্যে তাকালে, সহসা কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ- কেউ একজন বললো- নাও কবিতা পড়ো। তুমি নাম না জানা সেই কবির কাব্য পড়তে পড়তে ভাবলে- নাহ! আমার সমস্ত দুঃখ এই কবিকেই দিতে হবে। ততক্ষণে প্রতিটি শব্দ তোমাকে ধারণা দিয়েছে- জগতের সমস্ত দুঃখ বুকে ধারণ করেই একজন কবির জন্ম হয়। হঠাৎ উত্তুরে বাতাসটা দক্ষিণে ধাবমান- একটা সাদা পৃষ্ঠা উল্টে যেতেই সমস্ত অক্ষর কালো হতে হতে এক একটা মার্বেল চোখ। যেন- তোমার সমস্ত দুঃখবোধ মিলেমিশে একটা কবিতা হয়ে গেছে। কালের লিখন​ জানুয়ারি- ২০১৬