শনিবার, ১১ জুন, ২০১৬

নির্বাচিত কবিতায় সরদার ফারুক, শব্দে আঁকা সময়ের মুখ



কালের লিখন

নির্বাচিত কবিতা এমনিতেই সারের সার। সেখানে যদি কবিতাগুলো সু-নির্বাচিত হয় তাহলে তো কথাই নেই। সাধারণত একজন কবি তার সুদীর্ঘ কাব্যজীবনের উৎকৃষ্ট কবিতাগুলো উপস্থাপন করেন তাঁর নির্বাচিত কবিতায়। বাংলাসাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত প্রায় সকল কবির নির্বাচিত কবিতা বা কবিতাসমগ্রে মূলত সঞ্চিত হয়েছে মহাকালের পৃষ্ঠায় লিখিত বাণীবদ্ধ চেতনার নির্যাস। কবিতা বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়, কবিতা একটা নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠী বা সমগ্র মানুষের বোধের খোরাক। কিছু কল্পনাপ্রবণ সৃষ্টিশীল মানুষ যা রচনা করে থাকেন। কবিতা সাথে সাথে জনপ্রিয় অথবা লোকপ্রিয় হবার কিছু নয়, কবিতার সফলতা বিফলতা, বর্জন বা গ্রহণযোগ্যতা সময়ের হাতে। এরকম অসংখ্য উপমা আছে যে, জীবদ্দশায় যার কবিতা খুব বেশী পাঠ হয়নি, মৃত্যু পরবর্তী আরও অধিক সময় পরে তাঁর কবিতাই দিক নির্দেশনা দিচ্ছে মানুষের যাপিত জীবনবোধে। আবার এরকমও আছে, জীবদ্দশায় কোনো কবি হয়তো খ্যাতির শিখরে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়কাল পরে তাঁর লেখা পাঠকের বোধে রোদ ছড়াতে পারছে না। ছোট্ট করে আমরা একটা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছতেই পারি- কবিতা সময়ের নান্দনিক ছাপচিত্র এবং সময়ই কবিতার একনিষ্ঠ মুল্যায়ক।

সম্প্রতি পড়লাম কবি সরদার ফারুক এর ‘নির্বাচিত কবিতা’। পঁয়ত্রিশ বছরের দীর্ঘ কবিতা জীবনে প্রকাশিত ৮ টি বইয়ের নির্বাচিত কবিতা স্থান পেয়েছে এই বইটিতে, এছাড়াও আছে কিছু অগ্রন্থিত কবিতাও। ‘নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের ঋদ্ধ পরিবেশনায় যেসব কবিতাগ্রন্থ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে তা হলো- ‘আনন্দ কোথায় তুমি’, ‘পড়ে আছে সমুদ্র গর্জন’, ‘দীপালি অপেরা’, ‘উন্মাদ ভূগোল’, ‘ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ’, ‘দূরের জংশন’, ‘অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি’, ও ‘লিলিথ’(কাব্য নাটিকা)। ১৪৪ পৃষ্ঠার বইটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ করেছেন তৌহিন হাসান। ৩০০ টাকা মূল্যের বইটি প্রকাশ করেছে সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা- অনুপ্রাণন প্রকাশন।

কবি সরদার ফারুক তাঁর নির্বাচিত কবিতা বইটি উৎসর্গ করেছেন- ভূতলবাসী কবিদের...। কবিতার পাঠকমাত্রই জানা আছে, কবিতার কোনো বাঁধাধরা ব্যাখ্যা হয়না, অনুবাদ হয়না সকল অনুভবেরও। প্রশ্ন আসতে পারে- কেন তবে এই লেখা? -এই লেখা লিখছি মূলত একজন কবিতা পাঠকের অপার মুগ্ধতা থেকে। ভালোবাসার দায়বদ্ধতা আর একনিষ্ঠ কাব্যপ্রেম থেকে। আমি একটা ভালো বই পড়েছি, পাঠপরবর্তী আমার প্রতিক্রিয়া পড়ে যদি অন্যকোনো কাব্যপ্রেমী বইটি সম্পর্কে আগ্রহী হয় এবং পাঠ করে আমার চেয়েও বেশী তৃপ্তি পায় তবেই আমার এই লেখার সার্থকতা। এই লেখা কোন সাহিত্য সমালোচনা নয় বরং পাঠালোচনা শব্দটি এখানে অধিক যুক্তিযুক্ত।

দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়া কবি সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতার সকল কবিতা নিয়ে নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করতে গেলে হাজার পৃষ্ঠার বই হতে বাধ্য। এক একটি কবিতার একটি দু’টি পঙক্তি ধরেও লিখে ফেলা যায় প্রমাণ সাইজের একটা পুস্তিকা। চেষ্টা থাকবে নির্বাচিত কবিতা হতে কিছু কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের মুগ্ধতা আর কবির কাব্যশৈলীর কিছুটা রূপরেখা প্রণয়ন করার।

আনন্দ কোথায় তুমি কাব্যগ্রন্থের ‘মানুষ’ শিরোনামের কবিতাটি আমরা পড়তে পারি-

এইভাবে হয়ে ওঠো, হয়ে ওঠো নিজের ভেতরে
বেড়ে ওঠো রক্তবীজ, অবাঞ্চিত ভ্রূণ
ফুটে ওঠো অনায়াসে কিশোরীর গোপন কোরক

এইভাবে শিখে নাও শরীরের নিভৃত জ্যামিতি
শিকারীর নিবিড় কৌশল
ভ্রমরের চৌর্যকলা আর
পাষণ্ডের অবিবেকী ক্রীড়া
এইভাবে হয়ে ওঠো, হয়ে ওঠো ক্রমশ মানুষ!

রক্তবীজে মাখামাখি হয়ে অবাঞ্চিত ভ্রূণ অধ্যায় পেরিয়ে কিশোরীর গোপন কোরকে মানবফল হয়ে ফুটে ওঠা। এরপর শরীরের নিভৃত জ্যামিতি শিখে আবারও সেই একই চৌর্যকলা বা অবিবেকী ক্রীড়ায় মত্ত হওয়া, যেন মানুষ হয়ে ওঠা একটা ধাবমান চক্র। কবিতাটি পুনঃপাঠে এর আবেদন আরও স্পষ্ট হতে থাকে। এ যেন সীমার মাঝে অসীমের কলরব। অক্ষরবৃত্তের সাজানো শিল্প, একজন মানুষের সমূদয় জীবনচক্রের সাবলীল অনুভব।

সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতা পড়তে পড়তে একটা কথা বারবার মনে হয়েছে- এই কবির নিজস্ব একটা স্বর আছে, আছে নিজস্ব শব্দমালার বিচক্ষন প্রায়োগিকতা।  হিসেবী শব্দে বেহিসেবী জীবনের যাপিতকলার সুষম চিত্রায়ন খুব সহজ কাজ নয়, এই সহজ কাজটি কবি সরদার ফারুক করে গেছেন অনুপম দক্ষতায়।

আনন্দ কোথায় তুমি কাব্যগ্রন্থের- মনু ব্রীজ, এক্সোডাস, পাথরের পাখি, নির্মলা মিশ্র, উচক্কা বয়স কবিতাগুলো বিশেষভাবে ভাবনায় দোলা দেয়, চেতনার কার্নিশে বসে শুনিয়ে যায় জীবনের ভিন্ন সুরের অন্য এক রুপায়ন। ত্রাহি সিরিজের কাব্যগুলোও অনবদ্য। মনে রাখার মতো- ‘ঘাতকেরা বড় হয়ে ওঠে’ সিরিজটাও। ‘আনন্দ কোথায় তুমি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে 
এবার আমরা ‘সজারুর অবয়বে’ কবিতাটি পড়বো-

সজারুর অবয়বে আছি
মাঝেমধ্যে উন্মাদের কাছে যাই, বুঝে নেই
রিপুর উদ্যম

কখনো কখনো দেখি মানবিক প্রয়াসের
আকীর্ণ শ্মশানে
শৃগালের আমিষ উৎসব

গান গাইবার কালে কণ্ঠ চিরে গেলে
আর্তনাদ বলে মনে হয়
পারো যদি মুছে ফেলো
নিঃসঙ্গ পথের চিহ্ন, রক্তঝরা দিন

যাপিত সময়ের কাঠিন্য, হিংস্রতা আর বর্বরতা বোধযুক্ত মানুষের মনে কাঁটার মতো বিঁধে, তাই কবির উপলব্ধি সজারুর অবয়বে আছি। আবার উন্মাদের কাছে পাঠ নিচ্ছেন রিপুর উদ্যম। আর মানবিক প্রয়াসের আকীর্ণ শ্মশানে চলছে শৃগালের আমিষ উৎসব। এতসব ভয়াবহতার মধ্যেও কবি অনায়াসে উচ্চারণ করেন আশাবাদের গান, বলতে চান- মানবগান গাইতে গেলে কণ্ঠ চিরে যাবেই, চেরা কণ্ঠকে মনে হতে পারে আর্তনাদ, তাই বলে আর্তনাদ বুকে ধরে থেমে যেওনা, নিঃসঙ্গ পথের চিহ্ন মুছে দিও, মুছে দিও রক্তঝরা বিগতদিনের ক্রিয়াকল্প। কবি মাত্রই সত্যদ্রষ্টা, কবি মাত্রই অসুরের মাঝে বসেও সুরের রচয়িতা, আমরা সরদার ফারুক এর এই কবিতায় চিরকালীন সত্যের পথনির্দেশনা পাই।



কবি সরদার ফারুক এর কবিতার শরীর ঝরঝরে মেদহীন। শব্দের বাহুল্য নেই, চমকের বিশেষ প্রচেষ্টা নেই, মাঝে মাঝে মনে হতে পারে কিছুটা কাঠিন্য এসে ছুঁয়েছে কবিতার কোমলশরীর। পুনঃপাঠেই এই ভ্রান্তি দূরে চলে যায়, চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন পরমনিষ্ঠ শব্দপ্রেমিকের শব্দ প্রেম, প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দ সুচয়িত এবং সুচিন্তিত।
চলুন এবার সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতার ‘পড়ে আছে সমুদ্র গর্জন’ কাব্যগ্রন্থ হতে ‘মাতাল’ শিরোনামের কবিতাটি পড়ি-

মাতাল হলেই বুঝি, সব মনে আছে
রাতের সকল তারা দিনের আকাশে।
কাঁটাতারে ঘেরা
সারি সারি ক্রিসেনথিমাম
হরেকৃষ্ণ মালি বলত 'কিসন্তিবাম'-
মধ্যিখানে ফুটে ছিল বিশাল ডালিয়া।

এখনো পায়ের পাতা টলোমলো হলে
কার যেন খোপা খুলে পড়ে
আপট্রেন ছেড়ে যায় ঘুমন্ত শহর।

শব্দমাতালের সুগভীর মাতালামি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সুস্থতার সীমারেখায় মুখোশ পড়া যে স্থানু মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের বোধের মধ্যে রোদ নেই। তাদের চেতনার ধার নেই, যখনই একজন মানুষ স্মৃতিমাতাল হবে তখনি সে দেখতে পাবে- ঘুমন্ত শহর ছেড়ে যাওয়া আপট্রেন, সুসময়ের খোঁপা খুলে এলিয়ে পড়ছে পথ থেকে পথে।

সরদার ফারুক সময়ের কবি, কোনো দশকের বিভাজনে তাঁকে আঁটকে ফেলতে আমি নারাজ। সরদার ফারুক এর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, নিভৃত ধ্যানী এই শব্দঋষির ভাবনার জগত কাল পেরিয়ে মহাকালের, সীমানার বেড়াজাল পেরিয়ে সরদার ফারুক এর যাত্রা অসীমের দিকে। তাঁর বোধ সুশুদ্ধতার বলয়ে বাঁধা পরম সাচ্ছন্দতায়।

‘পড়ে আছে সমুদ্র গর্জন’ কাব্যগ্রন্থের- অবগাহন, কালের শেকল, ভাঙা হাট, কুণ্ডলী পাকানো সাপ শিরোনামের কবিতাগুলো ভাবে বিন্যাসে, সমসাময়িকতায় আর কবির নিজস্ব প্রকাশশৈলীতে দেদীপ্যমান। আমরা এবার ‘পড়ে আছে সমুদ্র গর্জন’ কাব্যগ্রন্থের নামভূমিকার কবিতাটি পড়বো।

তরল মোমের পরিচয়
কুসুমের উগ্র স্বাদ জানো,
সুড়ঙ্গ পথের বিস্মরণ?

কখনো মৃতের দেহে কাফন হয়েছো,
নিশ্চল মিনার?
তবে তো তীর্থের শেষ
পড়ে আছে সমুদ্র গর্জন

সরদার ফারুক এর কবিতা কখনো অস্পষ্ট, রূপক, ইঙ্গিতময়, বিচ্ছিন্ন, কিন্তু বারবার পাঠে পাঠকমনে জন্মায় একটা গভীর কিছু জানার স্পৃহা, বারবার ধরি ধরি করেও ধরতে না পারার আকুলতা সিক্ত করে চলে আসক্ত শাব্দিক মন। পাঠকে’কে ভাবনার খোরাক দিতে কবির কার্পণ্য নাই। কবির সমূদয় কার্পণ্য শব্দের বাহুল্যে। আর এই বাহুল্যহীন ছোট ছোট কাব্যের শরীর, কবি সরদার ফারুক’কে করে তুলে অন্যসব কবিদের চেয়ে আলাদা। এখানেই কবির নিজস্বতা।


কবিতার নির্দিষ্ট প্রকরণ নেই, কবিতার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাও নেই, তাহলে কবিতার কি আছে? কবিতার আছে মানবিক গান গাওয়ার সক্ষমতা। কবিতার আছে সুন্দরের জয়গান গাওয়ার অদম্যস্পৃহা, কবিতার আছে একটা অদ্ভুত সুরে সকল মানুষের কণ্ঠস্বর প্রকাশের সাবলীল ক্ষমতা। এই সক্ষমতার কথা বারবার মনে হয় সরদার ফারুক এর কবিতা পাঠে। এই কবির কবিতার পটভূমি বিষয়বৈচিত্রে ভরপুর, একজন প্রত্নতাত্ত্বিক যেভাবে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে আবিষ্কার করেন অমূল্য প্রাচীন। সেভাবে কবি সরদার ফারুক একজন শব্দতাত্ত্বিক হিসেবে তুলে এনেছেন মানুষের সমূদয় ভাবনার ইতিবৃত্ত।

সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতা থেকে- ‘দীপালি অপেরা’ কাব্যগ্রন্থের ‘পনের বছর পরে’ কবিতাটি এখন আমরা পড়বো-

পনের বছর পরে ফিরে এসে দেখি
আগের মতোই সব, চায়ের দোকানে
চেনা লোকজন-
ক্যারমবোর্ডের পাশে ভিড়;
মজিদ মিয়ার চুলে কলপ লাগায়
পুরোনো নাপিত

সেলুনের আয়নায় একবার দেখে নেই
নিজের চেহারা
বাঁয়ের রাস্তায় চিনিকল, ডানে গেলে
রিনিদের দোতলা দালান।

উদ্ধৃত কাব্যে আমরা পাই একজন মানুষের এক যুগেরও বেশী সময় পরে ফিরে আসার পর স্মৃতিকাতরতার পরিবর্তে একই দৃশ্যের পুনঃঘূর্ণায়ন। আমারা জানি মানুষ মাত্রই দীর্ঘদিন পরে ফিরে এলে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে, এ নেই, সে নেই, অমুক মারা গেছে তমুক শুধুই স্মৃতি। কিন্তু সরদার ফারুক এর এই কাব্যের স্মৃতিকাতরতা আমাদের মনে এক ভিন্ন রেখাপাত সৃষ্টি করে। পনের বছর পর ফিরে এসেও কবি দেখতে পান সব আগের মতোই আছে, চেনা লোকজন, ক্যারমবোর্ডের পাশে ভিড়, পুরনো নাপিত, সেলুনের আয়নায় নিজের পুরনো চেহারা দেখেই মনে পড়ে যায়, বায়ের রাস্তায় চিনিকল আর ডানে গেলেই রিনিদের দোতলা বাড়ি। কবিতা শেষ হতেই বুকের মধ্যে একটা শূন্যতা ভেসে ওঠে, আবার পড়তেই স্পষ্ট হয়, সব আগের মতোই আছে, তবুও ভিতরে ভিতরে কোথায় জানি তুমুল ক্ষরণ, নিদারুণ হাহাকারের গল্প। এখানেই সরদার ফারুক এর কবিতারা আমিত্ব ছেড়ে সার্বজনীন হয়ে ওঠে।



সরদার ফারুক এর কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট ছোট ছোট চিত্রকল্পে একটা বৃহৎ জীবনকাঠামোর পরিপূর্ণ চিত্রায়ন। কোথাও ছেঁড়াছেঁড়া চিত্রকল্প মিলেমিশে নানা রকম ভিন্নতা তৈরি করে এক আঁধারে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দীপালি অপেরা কাব্যগ্রন্থের মোজেজার দিন, বেলি ড্যান্স, সতীর প্রাসাদ, ব্রতকথা, পড়ালেখা, প্রখর এন্টেনা, রাখাল, সাঁতার, বিবাহের রীতি, মফস্বলে, বাতাসিয়া লুপ প্রভৃতি কবিতাগুলো অসাধারণ ভাবনার সুবিন্যস্ত প্রকাশ। এবার আমরা দীপালি অপেরা কাব্যগ্রন্থের নাম ভূমিকার কবিতাটি পড়বো-

ভেসে আছে ডানাকাটা পরী,
হিমে ভেজা হারমোনিয়াম-
আহা দীপালি অপেরা, ভুলে যাওয়া সুর
সেতু পার হলে মোহনগঞ্জের হাট

খড়ের গাদায় সিংহাসন,
হাতে হাতে মৃতসঞ্জীবনী

গ্রীনরুমে পেইন্টের ঘ্রাণ-
শেষ রাতে রঙিন ঘাঘরা
পুরাতন জাহাজের পাল হয়ে ওড়ে।

সরদার ফারুক রচিত দীপালি অপেরা কবিতাটি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, যখন যাত্রাগানের বিকাশ শুরু হয়। যাত্রাপালা বাংলার পুরনো সংস্কৃতির এক সোনালী অধ্যায়। কালের আবর্তনে আকাশ সংস্কৃতির ক্রমউন্নয়নে যাত্রাপালা এখন খাঁচায় বন্দী। যাত্রাগানের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়- ১৯৬৯ সালে গোপালগঞ্জের ধীরেন্দ্রকুমার বাকচী চালু করেন ‘দীপালি অপেরা’।  তিনি ১৯৭২ সালে ‘আদি দীপালি অপেরা’ এবং ১৯৭২ সালে স্ত্রী বনশ্রী বাকচীর সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ‘১ নং দীপালি অপেরা’ গঠন করেন। তিনি এসময়ে ‘নব দীপালি অপেরা’ এবং ‘দীপ দীপালি অপেরা’ নামে আরও দুটি যাত্রাদল প্রতিষ্ঠা করেন।

কবি সরদার ফারুক এর কবিতায় আছে মানুষের অনুভব, যাপিত জীবনের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ- হাসির সচিত্র অবস্থান, কবির কবিতায় আছে জীবনের বহুরৈখিক বিচিত্রতার গান। সরদার ফারুক এর কবিতায় আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, দ্রোহ, প্রেম আর মনোগত প্রলয়ের সাতকাহন।

এবার আমরা সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতা থেকে- ‘উন্মাদ ভূগোল’ কাব্যগ্রন্থের লজিং মাস্টার কবিতাটি পড়বো-

কাচারি ঘরের তক্তপোশে
ছেঁড়াখোঁড়া বই
চেয়ারে ময়লা শার্ট

দুপুরে ভাতের সাথে জল রঙা ডাল
বথুয়ার শাক
মাছ শুধু জলাশয়ে থাকে

মাঝে মধ্যে চিঠি আসে-
‘শরীলের যত্ন নিও বাপ’

শরীরে খিদেই থাকে, নানাবিধ খিদে
উঠোনে মোরগগুলো রাজার মতন
তারে ঝোলে সালমার লাল পায়জামা

লজিং মাস্টার কবিতাটি সরদার ফারুক রচিত একটি অনবদ্য জীবনাখ্যান এর গল্প। একটা সময়ের চিত্র সুনিপুণভাবে চিত্রায়িত হয়েছে এই কবিতায়, যে সময়ে অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থরা তাদের সন্তানের লেখাপড়ার জন্য একজন রানিং স্টুডেন্টকে লজিং মাস্টার হিসেবে রাখতেন, সেই সময় এখন আর নেই, কিন্তু কবির কবিতায় সেই স্মৃতিময় সময়ের চিত্র উঠে এসেছে। কাচারি ঘর, ছেঁড়াখোঁড়া বই, তরতাজা এক যুবকের মনোকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে একাকার এই কবিতায়। নানাবিধ ভাবনার খোরাক আছে এই কবিতার শরীর জুড়ে।

সরদার ফারুক এর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে- ভাবনার বহুমুখীতা, শব্দের খিড়কী দ্বার পেরিয়ে কবি পাঠককে পৌঁছে দেন তাঁর নিজস্ব বোধের আলোকপুঞ্জের কাছে।  ‘উন্মাদ ভূগোল’ কাব্যগ্রন্থের পলায়নপর্ব, আঙুরলতার পাশে, ঘন আগাছায়, ঋতু, বাগানবাড়িতে, টান, অপবাদ, ছাতা কিম্বা পানপর্ব কবিতাগুলো পাঠকমনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো। নামভূমিকার উন্মাদ ভূগোল কবিতাটিও ভিন্নতার পূর্ণমুকুল।



এবার আমরা সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতা থেকে- ‘ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা পড়বো। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর একক কোনো শিরোনাম নেই। ১,২,৩ ক্রমবিন্যাসে ৬২ টি ছোট বড় কাব্য স্থানপেয়েছে কাব্যগ্রন্থটিতে। প্রতিটি কবিতাই স্বীয় বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল। এই লেখার অবয়ব বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও ‘ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না, চলুন কিছু কবিতা পড়ি-

ট্রাভেল-ব্যাগের গায়ে ধুলো
কতোকাল আগে টার্মিনালে
টিকেট কেটেছি?
কোর্ট-কাচারির পরে পার্ক
কিছুদূর গেলে বাকল্যান্ড বাঁধ, সারি সারি লঞ্চ

একবার পকেটমারের হাতে বড় নাজেহাল
একবার ভুল করে অন্যের কেবিনে ঢুকে
বিশ্রী কেলেঙ্কারি
দূরের নৌকার থেকে কে যে কাকে ডাকে
‘সো লে মা ন, সো লে মা ন’

(ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ/ ৬)

কবিতাটি পাঠান্তে পাঠক মনে ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু দৃশ্যের অবতারণা হয়, আবার সব মিলিয়ে একজন মানুষের সামগ্রিক জীবন পরিভ্রমণের গল্পও এখানে বিদ্যমান, পাঠকের কানেও ভেসে আসে দূরের সেই  ‘সো লে মা ন, সো লে মা ন’ ডাক। আর একটি কবিতা পড়ি এই কাব্যগ্রন্থ হতে-

দরদাম করে খেতে হতো
সস্তার হোটেলে
জুতোগুলো ছিলো বেইমান
পরীরা যখন উড়ে এসে মহল্লায়
ঝড় তুলে যেতো
আমাদের ময়লা পোশাক
লুকোতে পারি নি

ভুল করে ভেবে গেছি কলম্বাস হবো

(ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ/ ২৪)

উদ্ধৃত কবিতাটি পাঠান্তে পাঠক মনে বাস করা সেই দিকভ্রান্ত অসফল কলম্বাসের মুখ ভেসে ওঠে, মুহূর্তের জন্য সেখানে বোধকরি নিজের রূপও ভেসে ওঠে। সামান্য সময়ে কবি সরদার ফারুক গেয়ে যান অসামান্য সব সময়ের গল্প, অসামান্য সব মুহূর্তের আবাদ তাঁর কবিতার জমিন জুড়ে। এবার একই কাব্যগ্রন্থ হতে আমরা আরও একটি কবিতা পড়বো-

ধৃত অপরাধীদের মতো নিচে বসে আছো
গ্রুপফটো ,সাদাকালো ,উনিশশো সাতাত্তর সাল
বিশিষ্ট জনেরা সব পেছনে দাঁড়ানো
টাই আর চশমায় বোঝা যায়

বাঁ থেকে চতুর্থ ,মাংকি ক্যাপ
হ্যাঁ উনিই ,কণিকার ছোটমামা
একবার সবার সামনে…

চিঠিটা কী করে তাঁর হাতে পড়েছিলো?

(ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ/ ২৫)

একটি এ্যালবাম, সেখানে একটা গ্রুপছবি, আর সেই ছবির ইতিহাস আর পিছনের আখ্যান নিয়ে পরিপূর্ণ একটা বিফল প্রেমকাহিনীর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা, ছোট ছোট শব্দের ফ্রেমে এরকম অসামান্য কাব্যভাষায় অনবদ্য কবিতা নির্মাণে সরদার ফারুক এর জুড়ি মেলা ভার। বাংলা সাহিত্যে মেদহীন কাব্য আর শব্দ ব্যাবহারে এত বেশী মিতব্যয়ীতা খুব কম কবির মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। অল্প কথায়, বিশাল আর বড় ক্যানভাস আঁকা, একজন দক্ষ শব্দশিল্পীর এক অনুপম গুণের প্রকাশ। আর একটা ছোট কবিতা উদ্ধৃত করছি-

গরুর গাড়ির থেকে এক আঁটি
ধান পড়ে গেছে
পথ জুড়ে পাখিদের পিকনিক

গাড়োয়ান পেছনে দেখেনি
সামনেই কালীগঙ্গা ব্রীজ

(ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ/ ২৮)

সামান্যক’টি শব্দে নির্মিত একটা কবিতার শরীর, অথচ এখানেই ঘুমিয়ে আছে মহাকালের গান। গরুর গাড়ি থেকে এক আঁটি ধান পড়ে গেলে যে পাখিদের পিকনিক হয় এই ভাবনা শুধু সরদার ফারুক এর মতো জীবনঘেঁষা কবির পক্ষেই বলা সম্ভব। যুগযুগ ধরে বয়ে চলা সামান্য একটা ঘটনা কীভাবে কবিতা হয়ে নাড়া দিতে পারে চিন্তার চাঞ্চল্য, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সরদার ফারুক এর কবিতা।

পাঠক হিসেবে ‘ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ’ কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুলো একটা বিশেষ অনুভবে মাখামাখি করে গেছে বোধের চৌকাঠ। আর কবি হিসেবে এই কাব্যগ্রন্থে সরদার ফারুক বারবার নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে গেছেন, নির্মাণ করেছেন একের পর এক কালজয়ী সব কাব্য, এই কাব্যগ্রন্থের ক্রমানুক্রমিক সবগুলো কবিতাই সুখপাঠ্য এবং বোধজাগানিয়া। আর একটা কবিতা উদ্ধৃত করে এই কাব্যগ্রন্থ থেকে বিদায় নিবো-

টাকাকড়ি ফুরিয়ে গেলেই
পাখি ধরে আনি
বেচে দেই নন্দীপুর হাটে
কিছুদিন মেঘ কিনি
শীতকালে সুলভ শিশির

গ্রাহকেরা এবারে চেয়েছে
ধুতুরা ফুলের বীজ
শতমূলী গাছের শেকড়

(ও সুদূর বীজতলা, মঠের গম্বুজ/ ৩২)




এবার আমরা সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতা থেকে- ‘দূরের জংশন’ কাব্যগ্রন্থের নাম ভূমিকার কবিতাটি পড়বো-

একদিন লিখবোই খরা আর শ্রাবণদিনের কথা
উন্মাদের বিধিলিপি,অক্ষরের অভিশাপ
ও আমার দূরের জংশন, ট্রেন কি এখনো আছে?

যারা পালানোর আগে ধরা পড়েছিলো
চোখে কালি, হাতে পুরাতন স্যুটকেস
তাদের লজ্জার ভঙ্গি লিখে যাবো দীর্ঘ কবিতায় 

দূরের জংশন কবিতায়, কবি সরদার ফারুক দীর্ঘকবিতায় পৃথিবীর চলমান যানে যাত্রারত, সকল যাত্রীর সমূদয় ভাবনার বিন্যাস লেখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন অবলীলায়। আমাদের শুনাতে চান জীবনের বারোয়ারী মঞ্চে মানুষের কত কতো দোদুল্যমান দোলাচল।

নির্বাচিত কবিতা পড়তে পড়তে একটা ব্যাপার খুব করে আকর্ষণ করেছে, সেটা হচ্ছে- অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উপর কবির অসামান্য দখল। ছোট ছোট পর্ব থেকে শুরু করে ২২ মাত্রার সুদীর্ঘ পর্বেরও সজ্জিত হয়েছে কবির কবিতার শরীর। জোড় শব্দের সাথে জোড় শব্দ ও বিজোড় শব্দের সাথে আর একটা বিজোড় অথচ প্রাসঙ্গিক শব্দ চয়নে সরদার ফারুক এর দক্ষতা ঈর্ষনীয়।

‘অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি’ কবি সরদার ফারুক এর একটি বহুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা স্থান করে নিয়েছে ‘নির্বাচিত কবিতা’ সংকলনে। এই কবিতাগ্রন্থের- পথ, বাজার, চন্দনচিকিৎসা, সিঁড়ি, পোলাপান, নাচের আখ্যান, ত্রয়ী, ইতিহাসযান, ভাষাতরু প্রভৃতি কবিতা যে কোনো কবিতাপ্রেমী পাঠকের মনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দ্বার খোলে দিবে, জাগিয়ে তুলবে চিন্তার উৎকর্ষ আর ভাবনার পরিধি।

আমরা এবার ‘অন্যদের তর্কে ঢুকে পড়ি’ কবিতাগ্রন্থের ‘আখেরি দস্তান’ কবিতাটি পড়বো-

অক্ষরবৃত্তের কারাগার থেকে বেরিয়ে পড়েছি।
শব্দমোহ, বাক্যের পাপ।
অচল মুদ্রার মতো ছুঁড়ে ফেলি পথে-
কবিতা আমাকে কিছুই দেয়নি
শুধু অপমান কুড়িয়ে পেয়েছি। নিজেই নিজের চোখ
উপড়ে ফেলতে গিয়ে আশ্চর্য বন্দরের কাছে থেমে যাই

পরিত্যক্ত জাহাজে জাহাজে ছেঁড়া পাল, নাবিকের কঙ্কাল
নারিকেলবীথি শেষ বিকেলের ছায়া নিয়ে শান্ত হয়ে আছে
বাণিজ্যের কথা অবান্তর। এ যেন গোপন সমাধিক্ষেত্র
শেষকৃত্যের পরে স্বজনেরা প্রার্থনা ভুলে ঘরে ফিরে গেছে। রাত হলে
রক্তমাখা চাঁদ ফিস্ ফিস্ করে বলে যাবে আখেরি দস্তান

শব্দপ্রেমী, ছন্দপ্রেমী, অক্ষরপ্রেমী, ভাব আর ভাষাপ্রেমী এক শব্দশ্রমিকের হৃদয়ের আকুতি সুগভীর বোধ নিয়ে উঠে এসেছে উদ্ধৃত কবিতায়। কোথাও যেন সুমধুর বিচ্ছেদের গানে বেজে যাচ্ছে করুণ বাঁশির সুর। কে না জানে- জীবন মূলত বেদনাবিধুর। মানুষ মাত্রই অভিমানী, কবিদের অভিমান ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে শব্দের কোণাকাঞ্চিতে। সরদার ফারুক এর নির্বাচিত কবিতা পড়তে পড়তে একজন পাঠক যত পৃষ্ঠা উল্টাবে, একের পর এক শব্দের কাঠামো বোধের রোদ জ্বেলে আলোকিত করে যাবে তার মননের চারপাশ, নতুন নতুন ভাবনা বিন্যাস, উপলব্ধ, স্মৃতি কিম্বা প্রীতি এসে ভিড় করবে ভাবুক মনের মনোকোঠায়।

জীবদ্দশায় একজন কবির নির্বাচিত কবিতা সংকলন নিশ্চয় বিশেষকিছু। আলোচ্য নির্বাচিত কবিতা সংকলনে সংযুক্ত হয়েছে একটি সুখপাঠ্য কাব্যনাটিকা, কাব্যপ্রেমী যে কোনো পাঠককে ‘লিলিথ’ নামের এই কাব্যনাটিকাটি দিবে পাঠ ভিন্নতার স্বাদ। কাব্যে কাব্যে একটা ভিন্ন মোহনায় নাব্য হবার সুযোগ। এছাড়াও আছে কবির অগ্রন্থিত বেশ কিছু কবিতা, যা পাঠক মনে জাগাবে বিশেষ মাধুর্য। অগ্রন্থিত কবিতার মধ্যে- রতিফল, গলিপথে, কুয়োতলা, উড়ন্ত সংসার, চোখের আড়ালে, জলের ফোঁটা প্রভৃতি কবিতা বিশেষভাগে উল্লেখযোগ্য। আমরা এবার নির্বাচিত কবিতা সংকলনে অগ্রন্থিত কবিতা হতে ‘দূরবীন’ কবিতাটি পড়বো-

অন্তরীক্ষে ঘোরে বুড়ো দূরবীন। কাচে লেগে আছে
গ্রহাণুর ধুলো, কালের সিনেমা, অতল খাদের জল
উলম্বরেখার কাছে এক পাহাড়ের নাভি
প্রসাধন ভেবে মাখে ফসিলের ছাই
ব্যাখ্যাতীত আলোর উল্লাসে
ভেসে যায় অগণিত বিচারের দিন

উদ্ধৃত কাব্য পাঠে মনে হয়- সময়ের বুড়ো দূরবীন হাতে সময়ের কবি সরদার ফারুক যাপিত জীবনের ভেসে যাওয়া অগণিত বিচার্য দিনের আচার্য হয়ে হাতে তুলে নিয়েছেন কালের কলম। যে কমল সময়ের একনিষ্ঠতা ছুঁয়ে হয়ে ওঠে দৃষ্টিমগ্ন শৈল্পিক দূরবীন। যে দূরবীনে দেখা যায় গ্রহাণুর ধুলো, কালের সিনেমা...

এই পাঠালোচনার শেষ কথা কবির কবিতা দিয়েই হোক-

মুগ্ধ হবে, এমন ভাবি না
তবু যদি চোখে পড়ে যায়
আমার নামের কাঙাল অক্ষরগুলো
সে লোভেই ঘোরাফেরা করে

সারারাত পদ্য লিখে টাঙিয়ে রেখেছি
মোড়ে মোড়ে, যাত্রীবাহী ট্রেনে

আর্দ্র হবে, অত আশা নেই
একবার ভুল করে পড়ো
অনাদৃত নামের বানান


(কাঙাল/ দীপালি অপেরা)


মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

পাখি কখন জানি উড়ে যায় ।। কালের লিখন

একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়
পাখি কখন জানি উড়ে যায়।
খাঁচার আড়া পড়লে ধ্বসে, 
পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, 
সেই ভাবনা ভাবছি বসে, 
সদা চমকজ্বরা বইছে গায়। 
কারবা খাঁচায় কেবা পাখি, 
কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, 
পাখি আমারি  আঙিনায় থাকি, 
আমারে মজাতে চায়। 
সুখের পাখি যাবে উড়ে, 
খালি খাঁচা রবে পড়ে, 
সঙ্গের সাথী কেউ না রবে, 
লালন ফকির কেঁদে কয়।
আলোচ্য বানীর রুপক শব্দের শব্দার্থ বিন্যাস

খাঁচাপাখিআঙিনাচমকজ্বরাআড়া। 

খাঁচা» পিঁজরা, পিঞ্জর, পিঞ্জিরা, টক্সগ, টোপা, অস্থিপঞ্জর, কাঠামো, খাদ্যদ্রব্য ঢেকে রাখার খোপ খোপ ঢাকনি। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে দেহ বা রুপকের আচ্ছাদনে  খাঁচা  বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো- কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা প্রভৃতি। (খাঁচার আড়া পড়ল ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
পাখি»পক্ষী, বিহগ, বিহঙ্গ, জৈব্যতা, জীবনিশক্তি, ব্রহ্মশক্তি, সঞ্জীবনী, যে শক্তির বলে বীজ অংকুরিত হয়, বায়োগ্র্যাফি, স্বায়ম্ভু, স্বয়ংসৃষ্ট, স্বয়ং অস্তিত্বশীল, জৈব্যতা। প্রাণিদেহে ব্যাপৃত চৈতন্যময়সত্তা। আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা জীবকোষকে জীবাত্মার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সূক্ষ্মশক্তিকে জৈব্যতা বা রূপকার্থে পাখি বলে থাকেন। (একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়পাখি কখন জানি  উড়ে যায়। – লালিত লালন)
আঙিনা»  আঙ্গিনা, অঙ্গন, উঠান, প্রাঙ্গণ, কোল, ক্রোড়, বুক, কাঁখ। আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা ভগ হতে ভৃগু পর্যন্ত স্ত্রী জননপথকে বৈতরণী, কানাই বা রুপকের আচ্ছাদনে আঙিনা বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  বৈতরণী, গয়া, গণ্ডকী, ফল্গু, বিরজা, মন্দাকিনী, যমুনা, সুরধুনী, সুরনদী, সুড়ংগ জননপথ, মর্ত্যধাম হতে স্বর্গধামে গমনের একমাত্র নদী, ভেজাইনা, উঠান, ডাংগা, দুয়ার, নদী, খাল, নালা, ক্যানাল, বরজখ, বিরজা। (কার বা খাঁচায় কে বা পাখি, কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, পাখি আমারি আঙিনায় থাকি, আমারে মজাতে চায়- লালিত লালন)
চমকজ্বরা»(চমক+জ্বরা) অত্যন্ত আতংকিত ভাব, ভীষণ বিস্ময়ভাব, অত্যন্ত ভীত ও আতংকিত হওয়ার ফলে শরীরে উৎপন্ন তাপ, হঠাৎ বিস্ময় হওয়ার কারণে এবং অতিরিক্ত হৃদকম্পনের ফলে শরীরে উৎপন্ন তাপ (খাঁচার আড়া পড়লে  ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
আড়া» আকৃতি, গঠন, ডৌল, প্রকার, রকম, ধরন। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে কায়া বা রুপকের আচ্ছাদনে আড়া বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, উষ্ট্র, গাছ, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি।
(খাঁচার আড়া পড়ল ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, এখন আমি ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়- লালিত লালন)
আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, সাঁইদর্শন, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহব্বান জানানো হয়েছে।
সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।
আলোচ্য বানীতে সাঁইজি আত্মারূপ পাখির উড়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। কখন কোন বিমার বা বদ হাওয়ায় দেহরূপ খাঁচা ছেড়ে আত্মারূপ পাখি উড়াল দেয়। তাই সাঁইজি উদাসনেত্র মেলে তাকিয়ে থাকেন অনাগত দিনে আর গেয়ে উঠেন- একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়, পাখি কখন জানি উড়ে যায়।
বিমূর্তশক্তিই ধীরে ধীরে মূর্তমান হয়ে উঠে। শক্তির মূর্তমান এ রূপটিকেই বলে আকার, দেহ, কাঠামো বা খাঁচা। আগুন, জল, মাটি, বাতাস ও বিদ্যুৎ- এ পাঁচ উপাদানে জীবদেহ সৃষ্টি। দেহতাত্ত্বিকরা এই পাঁচ উপাদানকে একত্রে আদি পঞ্চভূত বলে থাকেন। দেহকে জীবিত বা প্রাণবন্ত রাখতে প্রয়োজন হয় প্রাণশক্তি বা আত্মা। তাই বলা যায় দেহ হলো আত্মারই মূর্তমান রূপ। আত্মা বিমূর্ত কিন্তু দেহ মূর্ত। বিমূর্তশক্তি হতে সৃষ্টি হয় মূর্তমান দেহ। আত্মা ছাড়া কোন দেহই কল্পনা করা যায় না। অপরদিকে খাঁচা বা দেহ ছাড়া আত্মার আশ্রয় অসম্ভব, তাই সাঁইজি বলছেন- খাঁচা যদি ভেঙ্গে যায়, যদি আদি পঞ্চভূতের সুষম সমন্বয় না হয় বিদ্যুৎ শক্তি রূপ আত্মা বা পাখি এসে দাঁড়াবে কোথায়? সাঁইজি ভাবছেন দেহযন্ত্র বিকল হলে সকল বৃথা, পাখি ফাঁকি দিবে, অত্যন্ত ভীত ও আতংকিত দেহ-চিত্তে সাঁইজি বলছেন- খাঁচার আড়া পড়লে ধ্বসে, পাখি আর দাঁড়াবে কিসে, সেই ভাবনা ভাবছি বসে, সদা চমকজ্বরা বইছে গায়।
যখন দেহরূপ খাঁচা ছেড়ে একবার পাখি উড়ে যাবে তা আর পুনঃস্থাপিত হবেনা, একে অপরের কাছে অচেনা হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। কারো জন্য কারো ভাবনা নেই, নেই আঁখির জল। কোন কূল কিনারা থাকবেনা, কার খাঁচা আর কে পাখি। একদিকে দেহ পড়ে আছে নিথর, নিশ্চল, অন্যদিকে উড়ে গেছে দেহের পাঁচ উপাদানের একটি উপাদান বিদ্যুৎ শক্তি বা আত্মা, তাই সাঁইজি বলছেন-  কারবা খাঁচায় কেবা পাখি, কার জন্যে কার ঝরে আঁখি, পাখি আমারি আঙিনায় থাকি, আমারে মজাতে চায়।
বিদ্যুৎ এক প্রকার শক্তি। এ শক্তি ছাড়া প্রাণীকূল ও উদ্ভিদকূল এক মুহূর্তের জন্যও বাঁচতে পারেনা, তাই এই তড়িৎ বা বিদ্যুৎ শক্তিকেই জীবের প্রকৃত জীবাত্মা বলা হয়। হৃদপিণ্ডের মাধ্যমে দেহে যখন রক্ত সঞ্চালিত হয়। তখন রক্ত কণিকার ঘর্ষণে এ বিদ্যুৎশক্তিটি জীবদেহে উৎপন্ন হয়। এ শক্তিটি জীবদেহে বিদ্যমান থাকাকে জীবের জীবিত থাকা বলা হয়। এ শক্তিটি দেহ হতে বিলুপ্ত হওয়াকে জীবের প্রয়াণ বলা হয়। কোন কারণে হৃদযন্ত্রটি বিকল হয়ে গেলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন বন্ধ হয়ে যায় এবং জীব প্রয়াণলাভ করে। একবার বিদ্যুৎ শক্তিরূপ আত্মা বা সুখের পাখি দেহ ছেড়ে গেলে শুধু খালি খাঁচা পড়ে থাকে যাকে আমরা মড়ক বলি, আত্মা, মন আর জ্ঞানহীন খালি খাঁচা বা দেহের কোন সঙ্গী সাথী নেই, তাই মহাত্মা লালন ফকির কেঁদে বলছেন- সুখের পাখি যাবে উড়ে, খালি খাঁচা রবে পড়ে, সঙ্গের সাথী কেউ না রবে, লালন ফকির কেঁদে কয়।
আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, সাঁইজি বারবার তাঁর বানীতে দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব আর আত্মদর্শনের কথা বলে গেছেন। পৃথিবীর সুপ্রাচীন আত্মতত্ব, দেহতত্ত্ব, আর আত্মদর্শনের সার্বিক পরম্পরাজ্ঞান , সাঁইজি একজন সার্থক রুপকার হিসেবে তাঁর বানীতে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুন মুন্সিয়ানায়। বাংলা ভাষাভাষীর জন্য সাঁইজির নির্মাণ এক অনুপম আশীর্বাদ।
একজন মানুষের চারটি মূল সত্ত্বা- দেহ, আত্মা, মন আর জ্ঞান। একজন মানুষ যখন তার দেহের বিস্তারিত জানবে, পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গের ব্যাবহার বিধি জানবে, আত্মার প্রকারভেদ আর আত্মমুক্তির পথ জানবে, মনের প্রকারভেদ আর কার্যকরণ জানবে, সেই সাথে জানবে জ্ঞান বা মহাত্মার খুঁটিনাটি তখনি তার দিব্যজ্ঞান উদয় হবে।
আলোচ্য বাণীর আলোকে বলা যায়- আত্মার প্রকারভেদ, আত্মার অবস্থান, দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক, আত্মা অক্ষয়, অমর ও শ্বাশত নাকি ধ্বংসশীল? আত্মা ও দেহ কোনটি আগে সৃষ্টি, আত্মার মুক্তি রহস্য, প্রয়াণের পর আত্মার অবস্থানসহ আত্মার আত্মিক উন্নয়ন সাধনে সার্বিক তথ্য ও পরম্পরা জ্ঞান প্রত্যেকের নিজনিজ জ্ঞানগুরুর কাছ থেকে জেনে বুঝে নেয়া একান্ত কর্তব্য।
অথবা একজন আত্মতাত্ত্বিক দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন পাকা সাধকগুরুর সান্নিধ্য নিয়েই সকল মানুষের আত্মদর্শনের জ্ঞান আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।

তথ্যসুত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন»
  সম্পাদনা»  গবেষণা» 
 কালের লিখন

আরশিনগরের পড়শি ।। কালের লিখন

আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর,
সেথায় এক পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গেরাম বেড়ে অগাধপানি,
নাই কিনারা নাই তরণি, পারে,
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে,
আমি কেমনে সেথা যাইরে।
বলব কী সে পড়শির কথা,
তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা, নাইরে,
ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
পড়শি যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেত দূরে,
সে আর লালন একখানে রয়,
তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে।
আলোচ্য বানীর রুপক শব্দের শব্দার্থ বিন্যাস

আরশিনগর, পড়শি, গেরাম, অগাধপানি, লক্ষযোজন, নীর ।
আরশিনগর»  আয়নামহল, দর্পণগৃহ, গুপ্তগৃহ, কাঁচেরঘর, গোপনঘর, আয়না বা আরশি ছাড়াই নিজকে নিজে দেখা যায় এরূপ নগর। জঠরে সাঁইরূপ তরলমানুষ অবতারিত হলে সাধকগণ সাধনবলে তার সাক্ষাৎলাভ করতে পারেন বলে জঠরকে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা আরশিনগর বলে থাকেন। দেহতত্ত্বে স্ত্রী জননতন্ত্রের সন্তান ধারণ ও লালনকারী অংশকে গর্ভাশয় বা রুপকের আচ্ছাদনে আরশিনগর বলা হয়। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  কাশী, ঢাকা, নিধুয়া, মথুরা, হ্যাভেন, জান্নাত, আরশ, মদিনা, আকাশ, পাতাল, স্বর্গ, নিধুয়া প্রভৃতি।
(বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে- লালিত লালন)
পড়শি» প্রতিবেশী, প্রতিবাসী, বাড়ির কাছেই যার বাস। দেহরূপ বাড়ির খুব সন্নিকটে মানবের তরলরূপ সাঁই অবতরণ করেন বলে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা সাঁইকে পড়শি বলে থাকেন। মাতৃজঠরে জীবের ভ্রণ লালন-পালনকারী সুমিষ্ট সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রুপকের আচ্ছাদনে  পড়শি বলা হয়। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো-  পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, গার্ডিয়ান, রব, উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ, উপাস্য, পালক, সাঁই প্রভৃতি।
(পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে, সে আর লালন একখানে রয়,তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে – লালিত লালন।)
গেরাম»  গ্রাম, গাঁ, পল্লি, পাড়াগাঁ, দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, জাসাদ। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা জীবের দৃশ্যমান স্থূল আকারকে দেহ বা রুপকের আচ্ছাদনে  গেরাম বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ হলো- কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা প্রভৃতি।
(গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, নাই কিনারা, নাই তরণি পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখবো তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে- লালিত লালন)
অগাধপানি » অথৈজল, গভীরজল, গভীরজ্ঞান, সূক্ষ্মজ্ঞান, দিব্যজ্ঞান, আধ্যজ্ঞান, আধ্যাত্মিকজ্ঞান
(গেরাম বেড়ে অগাধপানি, নাই কিনারা নাই তরণি পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে- লালিত লালন)
লক্ষযোজন» অনেক যোজন, অনেক ব্যবধান, আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা মূলককে আচ্ছাদিত করার প্রয়াসে রুপকে নতুন শব্দ নির্মাণ করেন, তাঁরা অনেক সময় এক কে একলক্ষ বা চার কে চারলক্ষ বলে থাকেন, রুপক সাহিত্যে মূলকের পরবর্তী শূন্যের বিশেষ কোন মুল্য নেই। সেজন্য ১,০০,০০০ হতে দু’টি শূন্য বাদ দিলে ১,০০০ অবশিষ্ট থাকে। ফলে লক্ষযোজন সমান হাজার বছর বা হাজার শ্বাস বলা হয়ে থাকে।
নীর» জল, বারি, সলিল, রস,  নৈর। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা মাতৃজঠরে জীবের ভ্রণ লালন-পালনকারী সুমিষ্ট সুপেয় ও শ্বেতবর্ণের অমৃতরসকে পালনকর্তা বা রুপকের আচ্ছাদনে নীর বলে থাকেন। এর আরও কিছু রুপক প্রতিশব্দ  হলো-  পালনকর্তা, ঈশ্বর, প্রভু, বিষ্ণু, বুদ্ধ, স্বামী, গার্ডিয়ান, রব, উপাস্য, নারায়ণ, নিধি, নিমাই, নিরঞ্জন, স্বরূপ, উপাস্য, পালক, সাঁই প্রভৃতি।
(কী বলব সে পড়শির কথা, তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে, সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর, সে ক্ষণেক ভাসে নীরে- লালিত লালন)
আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আত্মতত্ত্ব দেহতত্ত্বের প্রাণপুরুষ, সাধককুল শিরোমণি বাঙালি ভাষাভাষীদের জন্য মহান রূপকার, বাংলাভাষার মরমিকবি, আত্মতত্ত্বের জনক মহাত্না লালন সাঁইজি। মহান আধ্যাতিক জ্ঞানতাপস ও জীবন ঘনিষ্ঠ আত্মতাত্ত্বিক দার্শনিক মহাত্না লালন সাঁইজি একজন সুমহান রূপকার হিসেবে রুপকের অন্তরালে আত্মতত্ত্বের কথা বলে গেছেন তাঁর নির্মিত সকল বাণীতে, সাঁইজির বাণীর মূল শিক্ষা হলো- মানব জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য নিজেকে জানা অতি জরুরী, মানুষতত্ত্ব- শ্রেষ্ঠতত্ত্ব, ভাব নয় বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে মূলে ধাবিত করে। সাঁইজির প্রতিটি সহজ পদ আত্মদর্শনের অমিয় বাণী, এর তাল, লয়, ছন্দ, ভাব, ভাষা, শব্দের গাঁথুনি, উপমাশৈলী আর রুপকের অন্তরালে মূলকের আভাস, মোহিত করে অনুসন্ধিৎসু মন।
মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহ্বান জানানো হয়েছে।
আলোচ্য বানীতে সাঁইজি বাড়ির পাশেই একটা আরশিনগরে তাঁর পড়শির সন্ধান করেছেন। বাড়ির পাশেই তার বসবাস, অথচ সেই পড়শিকে একদিনের জন্যও দেখতে না পাওয়ার বেদনা, কৌতূহল আর আকাংখা ফুটে উঠেছে আলোচ্য বাণীটিতে।
সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।
আত্মতত্ত্বের আলোকে যদি আমরা বানীটির স্বরূপ উদঘাটন করতে যাই দেখবো সাঁইজি তাঁর পড়শিরূপ মনের মানুষ সাঁইয়ের সন্ধান করছেন আরশিনগর রূপ মাতৃজঠরে। দেহরূপ বাড়ীর ভিতরে জঠররূপ আরশিনগর বা বারামখানায় পড়শির বসবাস। একই অঞ্চলে বসবাস অথচ একদিনও পড়শির দেখা নেই, তাই সাঁইজি বলছেন- আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
গেরামের অন্তরালে দেহনামক নগরীর আনাচে কানাচে অগাধপানির মতো দিব্যজ্ঞানের ছড়াছড়ি, যার কোন কূল- কিনারা নাই, নাই সেই আধ্যজ্ঞান রূপ দেহ সায়র পাড়ি দেবার কোন তরণিও, এই দেহনামক নগরের কোন জায়গায় পড়শির অবস্থান, কিভাবে তার কাছে গিয়ে মনের বাঞ্ছা বা আশা পূরণ করবো এই ভাবনায় ব্যাকুল পড়শি প্রেমি সাইজি। সাঁইজি বলছেন-গেরাম বেড়ে অগাধপানি, নাই কিনারা নাই তরণি, পারে, মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে, আমি কেমনে সেথা যাইরে।
এতক্ষনে সাঁইজি তাঁর পড়শির বর্ণনা দিচ্ছেন, কি বলবো সেই সাঁইরূপ পড়শির কথা, মাসান্তে একবার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথাহীন তরলমানুষ নিত্যধামে অবস্থান করেন, শুন্যে অর্থাৎ ব্রহ্মতালুতে মস্তিস্ক মেরুজল উৎপত্তি হয়ে তা বৈয়াম্বুযোগে মূলাধার চক্র ঘুরে গর্ভাশয়ে নীরের মতো মীন রুপে ভাসতে থাকেন, সাঁইজির প্রানের পড়শি, মানুষের তরল বা সাকার রূপ, মানবের উপাস্য স্বয়ং সাঁই। সাঁইজি বলছেন- বলব কী সে পড়শির কথা, তার হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা, নাইরে, ক্ষণেক থাকে শূন্যের ওপর আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
চাতক বা শুদ্ধ সাধকের ন্যায় সাঁইজির প্রার্থনাময় আকুলতা- যদি একবার নিজের স্বরূপ দর্শন হতো, পড়শির সন্ধান পেতাম, একবার ছুঁতে পারলে সেই অধর চাঁদকে, মানবকর্ম সারা হতো, ভবের যম যাতনা সকল দূরে চলে যেতো, অমৃতজল রূপ সাঁইকে আহরণ করে জন্ম মৃত্যু রহিত করে ঘটতো আত্মমুক্তি, প্রতিষ্ঠা পেতো আত্মার অখণ্ডতা।  জনমভর পড়শি আমার বাড়ির আঙিনাতেই থাকে, একইখানে বসবাস ব্যাক্তি লালন সাঁইজি আর তাঁর পড়শি জগতের পালনকর্তা লালনের, এ উভয় লালন একদেহে অবস্থান করলেও ব্যক্তি লালন উপাস্য লালনের সাথে সাক্ষাতলাভ করতে প্রায় একহাজার শ্বাস সময়ের প্রয়োজন হয়। আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা এই একহাজার শ্বাসকে হাজার মাস, হাজার বছর, হাজার যোজন বলে থাকেন। হাজার যোজনকে আবার লক্ষযোজন, লক্ষবছর, লক্ষভুবন, লক্ষযোনি ইত্যাদি বলা হয়।
সোনারতরী কাব্যে যেমন রবি ঠাকুর বললেন- এতকাল নদীকূলে, যাহা লয়ে ছিনু ভুলে, সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে, এখন আমারে লহ করুণা করে। তদ্রুপ সমর্পিত আকুলতা, আকাংখা আর প্রেম দেখতে পাই সাঁইজি যখন বলেন-  পড়শি যদি আমায় ছুঁতো, যম যাতনা সকল যেত দূরে, সে আর লালন একখানে রয়, তবু লক্ষযোজন ফাঁকরে।
আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, সাঁইজি বারবার তাঁর বানীতে মনেরমানুষ, অধরমানুষ, প্রেমেরমানুষ, ভাবেরমানুষ তথা পড়শি রূপ তরল মানুষের কথা বলে গেছেন, পৃথিবীর সুপ্রাচীন আত্মতত্ব, দেহতত্ত্ব, আর আত্মদর্শনের সার্বিক পরম্পরাজ্ঞান, সাঁইজি একজন সার্থক রুপকার হিসেবে তাঁর বানীতে ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুন মুন্সিয়ানায়।
বাংলা ভাষাভাষীর জন্য সাঁইজির নির্মাণ এক অনুপম আশীর্বাদ। তাই আরশিনগরের পড়শির সন্ধান পেতে, গুরুর পাঠশালায় ভর্তি হয়ে, দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করতে হবে সবার আগে। নচেৎ লালন বানী পড়শির মতোই অধরা থেকে যাবে জনমভর। আরশি নগরের পড়শির সার্বিক তথ্য, যোগাযোগের ঠিকানা আর কোন দিন কোন সময় পড়শির সাথে দেখা হয়, এসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ তত্ত্বের গভীর হতে গভীরতম আলোচনা, ব্যাখ্যা, আর আত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রত্যেকের নিজ নিজ জ্ঞানগুরুর কাছ থেকেই জেনে বুঝে নেয়া উচিৎ। অথবা  একজন আত্মতাত্ত্বিক দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন  পাকা সাধকগুরুর সান্নিধ্য নিয়েই সকল মানুষের আত্মদর্শনের জ্ঞান আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।

তথ্যসুত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন»
  সম্পাদনা»  গবেষণা» 
 কালের লিখন