চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে,
আমরা ভেবে করব কী,
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম,
তাকে তোমরা বলো কী।
ছয়মাসের এককন্যা ছিল,
নয়মাসে তার গর্ভ হলো,
এগার মাসে তিন সন্তান হলো,
কোনটা করবে ফকিরি।
ঘর আছে দুয়ার নাই,
মানুষ আছে তার কথা নাই,
কেবা তার আহার জোগায়,
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি।
লালন সাঁইজি ভেবে বলে,
মাকে ছুঁলে মরে ছেলে,
এ তিন কথার অর্থ নইলে,
তার হয় না ফকিরি।
মহাত্মা লালন সাঁইজি রচিত প্রতিটি লালনবানী পাঠের দ্বারা আমরা সুখী ও ছোট পরিবার গঠন, পরমায়ু বৃদ্ধি, শুক্রনিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সুস্বাস্থ্য রক্ষা, সাঁইদর্শন, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন ও আত্মসংযমসহ বিশ্বব্যাপী শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যাক্তিক জীবনে অনুপম শিক্ষা পেয়ে থাকি। সকল লালনবানীর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মানুষের মনের পশুত্বভাব দূর করে সুস্বভাব ও মানবিক গুণাবলী অর্জনের আকুল আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই সাঁইজির উদাত্ত কণ্ঠের আহব্বান- “সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন, সত্য সুপথ না চিনলে, পাবি না মানুষের দরশন।”
সাঁইজির বানী সাধারণত দুটি বা তারও অধিক অর্থ একই সাথে বহন করে, ব্যাখ্যা অর্থ বা ভাবার্থ, বিশ্লেষক ভেদে যাই আসুক, আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সকল যুগে সর্বাবস্থায় একই রকম থাকবে, কারন সাইজির বানীর মূল উপজীব্য বিষয় হলো মানুষ। দেহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ব্যাতিত সাঁইজির বানীর পাঠউদ্ধার সম্ভব নয় কিছুতেই, উল্লেখ্য- যে লেখা যে বিষয়ে রচিত তাকে সে ভাবেই পাঠ করতে হবে, অন্য বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজলে তা মূল হারিয়ে ভিত্তিহীন হবে বৈকি।
প্রথমে আমরা আলোচ্য বানীতে ব্যবহার করা হয়েছে এরকম কিছু শব্দের আভিধানিক ও দেহতাত্ত্বিক অর্থ বিন্যাস করবো, তারপর আলোচ্য বাণীর ভাবার্থ বিশ্লেষণ করবো-
আলোচ্য বানীর রূপক শব্দের অর্থ বিন্যাসঃ
চাঁদ, ঝি, মা, ছয়মাসের কন্যা, নয়মাসের গর্ভ, এগারো মাসের সন্তান, ফকিরি, ঘর আছে দুয়ার নাই, মাকে ছুঁয়ে ছেলে মরা।
চাঁদঃ চন্দ্র, শশী, নিশাকর, প্রীতি উৎপাদনের বস্তু (চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা), বয়সের প্রতি সম্বোধন (চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে) অসুন্দর বা অবাঞ্ছিতব্যক্তি (চাঁদসুন্দর যায়) দেহতত্ত্বে চাঁদ হচ্ছে- দেহ, সাঁই, যৌবন, রজ, পবিত্রতা। চাঁদ আত্মদর্শনের একটি প্রত্যয় বিশেষ (গুরুচন্দ্র, যুগলচন্দ্র, দয়াল চাঁদ, গুরু চাঁদ) (চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী, ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলো কী- লালিত লালন) আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানে চাঁদ হচ্ছে- যৌবন, তারুন্য, তরুণকাল, যুবাকাল, দি পিরিওড ওফ ইয়থ, আইয়ামুশ শাবাব, চন্দ্রচেতনকাল, কামচেতনাপ্রাপ্ত বয়স। বাংলা দৈবিকায় চাঁদ হচ্ছে- ধনী, বণিক, সম্পদশালী। চাঁদের আরও কিছু অভিধা- জোয়ান, পুলসিরাত্ব, গনি, মালেনিসাব, ইয়াং, এ্যাডাল্ট। আত্মদর্শনের সংজ্ঞা- ১১ হতে ৪০ বছরের মধ্যবর্তী তারুণ্যতাকে যৌবন বা রূপকার্থে চাঁদ বলা হয়।
চাঁদের গায়ে চাঁদ লালাঃ কিশোরচাঁদের গায়ে যৌবনচাঁদ উদিত হওয়া, নারিচাঁদের ওপর সাঁইরূপ চাঁদ উদিত হওয়া, রজস্বলাদের পবিত্রতারূপ চাঁদের গায়ে রজরূপ চাঁদ উদিত হওয়া (চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী, ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলো কী- লালন)।
ছয়মাসের কন্যাঃ ছয় মাস বয়সের কন্যা সন্তান (ছয়মাসের এক কন্যা ছিল, নয়মাসে তার বিয়ে হলো, এগারমাসে তিনসন্তান হলো, কোনটা করবে ফকিরি- লালন) আত্মতত্ত্বে ছয়রিপু- ১.কাম ২.ক্রোধ ৩.লোভ ৪.মোহ ৫.মদ ও ৬.মাৎসর্য্য এ ছয়রিপুকে একত্রে ছয়মাসের কন্যা বলা হয়।
কন্যাঃ মেয়ে, তনয়া, দুহিতা, আত্মজা, সুতা, নন্দিনী, কুমারী, পাত্রী, বধূ, নববধূ, কুমারী মেয়ে, অবিবাহিতা নারী, বিবাহের উপযুক্তা নারী, ভাবীবধূ, বিবাহ অনুষ্ঠানের নায়িকা, কন্যারাশি, রাশি বিশেষের নাম।
ঝিঃ কন্যা, দুহিতা, মেয়ে, তনয়া, কুমারী, নন্দিনী, চাকরানি, দাসী, পরিচারিকা ১.(চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী, ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলো কী- লালন) ২.(জল থেকে হয় মাটির সৃষ্টি, জাল দিলে হয় গো মাটি, বুঝে দেখ এ কথাটি, ঝিয়ের পেটে মা জন্মায়- লালন) আত্মদর্শনে ঝি হচ্ছে- দেহ, কায়া, খাঁচা, ঠাট, ধড়, পিঞ্জর, শরীর, গা, গতর, বডি, জাসাদ, জিসম, বদন, কংকাল, কলেবর, কাঠামো, উষ্ট্র, গাছ, ঘোড়া, তপোবন, তিব্বত, দশরথ, নদিয়া, নবদ্বীপ, পাহাড়, ব্রহ্মাণ্ড, মেঘ, সংসার, হাতি, কল্পতরু, কল্পদ্রুম, কল্পবৃক্ষ, কল্পলতা।
রূপকসাহিত্যের একটি দৈবিকা বা প্রতীতি, জীবের স্থূল আকারকে দেহ বা রূপকার্থে ঝি বলা হয়। ঝি শব্দের আরও কিছু অভিধা- ওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্স, আলম, ক্ববর, গোর, জাহান, রথ, দেহ।
তিনসন্তানঃ তিনটি ধারা, তিনটি তার, তিনটি মাধ্যম ১.(এক মেয়ের নাম কলাবতী, নয় মাসে হয় গর্ভবতী, এগারমাসে সন্তান তিনটি, মেজটা তার ফকির হয়- লালন) ২.(ছয়মাসের এককন্যা ছিল, নয়মাসে তার গর্ভ হলো, এগারমাসে তিন সন্তান হলো, কোনটা করবে ফকিরি- লালন) ৩.(মরা যখন কবরে নেয়, তিনটি সন্তান জন্ম হয়, তিনজনা তিনদেশে যায়, মরা লাশ ফেলে দিয়ে- লালন)। দেহতত্বে- ১.শুক্র, ২.সুধা ও ৩.মধু- এ তিনটি ধারাকেই তিনটি সন্তান বলা হয়।
সন্তানঃ সন্ততি, অপত্য, বংশধর, ফল, বংশ, গোত্র, ধারা, প্রবাহ, ব্যাপ্তি, বিস্তার।
নয়মাসে গর্ভ হওয়াঃ নয় মাসের মধ্যে গর্ভ সঞ্চারিত হওয়া ১.(এক মেয়ের নাম কলাবতী, নয়মাসে হয় গর্ভবতী, এগারমাসে সন্তান তিনটি, মেজটা তার ফকির হয়- লালন) ২.(ছয়মাসের এককন্যা ছিল, নয়মাসে তার গর্ভ হলো, এগারমাসে তিনটি সন্তান, কোনটাতে হয় ফকিরি- লালন)। মানবদেহের নয়টি দ্বার- দুই চোখ, দুই কর্ণ, নাসিকার দুই ছিদ্র, মুখ, জলদ্বার ও মলদ্বার- মানবদেহের এ নয়টি দ্বার বা ১.চোখ, ২.কান, ৩.নাক, ৪.মুখ, ৫.মল, ৬.মূত্র, ৭.রতী, ৮.রজ ও ৯.সাঁই- মানবদেহের এ নয়টি দ্বার। রূপকসাহিত্যে মানবদেহের নয়টি দ্বার সক্রিয় হওয়াকে গর্ভ হওয়া বলা হয়।
গর্ভঃ ভিতর, মধ্য, তলদেশ, উদর, জঠর, জরায়ু, গর্ভাশয়, ভ্রুণ, জঠরস্থ সন্তান, অন্তসত্তা অবস্থা। ঢাকা, নিধুয়া, মথুরা, কাশী, বৈকুণ্ঠ, স্বর্গ, নিধুয়া, গর্ভাশয়।
এগারমাসঃ এগারটি মাস, এগারতম মাস, ১১ স্ত্রী, ১১ গিন্নি। দেহতত্ত্বে- নয়টি প্রকাশ্যদ্বার, শুক্রদ্বাররূপ গুপ্তদ্বার ও রজদ্বাররূপ গুপ্তদ্বার- এ মোট ১১টি দ্বারকে রূপকসাহিত্যে এগারমাস বলা হয়। ১.(এক মেয়ের নাম কলাবতী, নয়মাসে হয় গর্ভবতী, এগারমাসে সন্তান তিনটি, মেজটা তার ফকির হয়- লালন) ২.(ছয়মাসের এক কন্যা ছিল, নয়মাসে তার বিয়ে হলো, এগারমাসে তিনসন্তান হলো, কোনটা করবে ফকিরি- লালন)। এগারটি দ্বার, এগাররুদ্র, দুই চোখ, দুই কর্ণ, নাসিকার দুইটি ছিদ্র, মুখ, জলদ্বার মলদ্বার শুক্রদ্বার ও রজদ্বার- মানবদেহের এ এগারটি দ্বার {বাং.এগার+ বাং.মাস}
ফকিরিঃ বিদ্যাচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা, দার্শনচর্চা, বুদ্ধিবত্তা। মরমিসাধনার কলাকৌশল, আধ্যাত্মিকসাধনার পদ্ধতি (কেউ রাজা কেউ বাদশাগিরি, ছেড়ে কেউ করে ফকিরি, আমি এ নিমাই কী ছার নিমাই, কী ধন ছেড়ে বেহাল পরেছি গায়-লালন)
মাঃ মাতা, জননী, গর্ভধারিণী, মাতৃস্থানীয়া নারির প্রতি সম্বোধন, কন্যা বা কন্যাস্থানীয়া নারির প্রতি সম্বোধন। বিস্ময়, ভয়, আতংক (ওমা)। স্বরগ্রামের মধ্যম বা চতুর্থ সুর। জগম্ময়ী, জগম্মাতা, বিশ্বমোহনকারিণী, ভুবনময়ী, ভুবনমোহিনী, বিশ্বজননী আদ্যাশক্তি, কালী, পৃথিবীর মাতা, সর্বব্যাপিনী ও সর্বত্র বিরাজিতশক্তি (নিগূঢ় বিচারে সত্য তাই গেল জানা, মায়েরে ভজলে হয় বাপের ঠিকানা- লালন)। দেহতত্বে- শুক্র, বীর্য, বিন্দু, রতী, সিমেন, মনিউ, নুত্বফা, রুজুলাত। গোবিন্দ, অহল্যা, কালী, জল, বারি, দুর্গা, পিতৃধন, বৈষ্ণবী, সীতা, আদম, ওয্যা, জিন,পরী, বিলকিস, যাকাত, জুলেখা, লুত্ব। শুক্র পরিবারের সদস্য বিশেষ, রূপকসাহিত্যের একটি দৈবিকা বা প্রতীতি। কামব্রতের সময়ে শিশ্ন হতে নিঃসৃত শুভ্রবর্ণের তরল পদার্থকে শুক্র বা রূপকার্থে মা বলা হয়। আঙ্গুর, খেজুর, রুটি, ফল, কমলা, বেহুলা, রতী, সীতা,ধন, শুক্র।
মাকে ছুঁয়ে ছেলে মরাঃ রূপকসাহিত্যে শুক্রকে মা, শিশ্নকে ছেলে এবং শুক্রপাতকে মরণ বলা হয়। কামব্রত পালনে গিয়ে শিশ্ন যদি শুক্ররূপ মাতাকে স্পর্শ করে অর্থাৎ শুক্রপাত করে তবে মারা যায়। রূপকসাহিত্যে তাই বলা হয় মাকে ছুঁলে ছেলে মরে। ১.(মাকে ছুঁলে পুত্রের মরণ, জীবগণে তাই করে ধারণ, ভেবে কয় ফকির লালন, হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গবার নয়- লালন) ২.(লালন সাঁইজি ভেবে বলে, মাকে ছুঁলে মরে ছেলে, এ তিন কথার অর্থ নইলে, তার হবে না ফকিরি- লালন)।
আলোচ্য বানীর ভাবার্থ ও আত্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণঃ
আত্মতত্ত্বের আলোকে যদি আমরা বানীটির স্বরূপ উদঘাটন করতে যাই দেখবো আলোচ্য বানীতে সাঁইজি মানবজীবনের সেই সময়টার দিকে আলোকপাত করেছেন, যখন একজন মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। মানুষের মনের চারটি অবস্থা- অবচেতন, অচেতন, চেতন ও সচেতন। যৌবনপ্রাপ্ত হবার পরেই সাধারণত মানুষের অচেতন মন চেতন প্রাপ্ত হয়। অধিকাংশ মানুষের মনই এই চেতন পর্যায়ে থেকে যায় সারাজীবন। যখন একজন মানুষ দিব্যজ্ঞানী কোন গুরুর কাছে আত্মদর্শন জ্ঞান লাভ করেন, অধ্যয়ন করেন দেহনামক বিশ্ববিদ্যালয়, তখনি তার মন চেতন থেকে সচেতন হয়। সাধারণ মানুষ দুই পায়ে চলে, দিব্যজ্ঞানী সাধুরা ছয় পায়ে চলে। দেহতত্ব পাঠের সাথে সাথে নাসিকার দুই শ্বাস আর মন জ্ঞান তার নিত্যদিনের চলার সাথী হয়ে যায়।
চেতন মন থেকে সচেতনে পৌঁছার ক্রিয়া হিসেবে লালন সাঁইজির উচ্চারণ-
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করবো কী,
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম
তাকে তোমরা বলো কী।
আত্মদর্শনে চাঁদ একটা প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহার হয়, মানে শব্দের মাধুর্য বা দ্যোতনা বৃদ্ধি করে, যেমন- দয়াল চাঁদ, নিতাই চাঁদ, গুরু চাঁদ, কিম্বা চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। দেহতত্ত্বীয় মূলকগুলোর অশ্লীলতা পরিহার করার জন্য আত্মতাত্ত্বিক রুপকারগন নতুন নতুন রূপক শব্দ নির্মাণ করে থাকেন। অনেকটা মূল জিনিসটাকে রুপকের আচ্ছাদনে মুড়িয়ে দেয়া যাতে অশ্লীলতা পরিহার হয় এবং মানুষের জানার ইচ্ছেটা বেশি করে জাগ্রত হয়। সাঁইজি আলোচ্য বানীতে চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা বলতে বুঝাচ্ছেন- কিশোরচাঁদের গায়ে যৌবনচাঁদ উদিত হওয়া। রজস্বলাদের পবিত্রতারূপ চাঁদের গায়ে রজরূপ চাঁদ উদিত হওয়া। সহজ কথায় কিশোর বা কিশোরীদেহ যখন যৌবন প্রাপ্ত হয় তখনি চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগে, অর্থাৎ কিশোর চাঁদের গায়ে যৌবন চাঁদের উদয় হয়। কিশোরচাঁদের গায়ে যৌবনচাঁদ উদিত সওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেহরূপ ঝিয়ের অভ্যন্তরে শুক্ররূপ মায়ের উদয় বা অভ্যুদয় হয়ে থাকে। (আত্মতত্ত্বে দেহকে ঝি আর শুক্র কে মা বলা হয়) আর এ কথা আমরা সবাই জানি যে- কোন কিশোর যুবক না হওয়া পর্যন্ত তার দেহে শুক্র উৎপন্ন হয় না। এজন্যই সাঁইজি আগে চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার কথা বলে, পরে ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্মের কথা বলেছেন। মহাত্মা লালন সাঁইজি একজন রুপকার হিসেবে এখানে ঘোষণা করেছেন যৌবনের জয়গান।
ছয়মাসের এককন্যা ছিল,
নয়মাসে তার গর্ভ হলো,
এগারমাসে তিন সন্তান হলো,
কোনটা করবে ফকিরি।
আত্মদর্শনে কিছু মূলকসংখ্যা আছে যেমন-
১. নিরীক্ষ = ১.নিরীক্ষ।
২. ফল = ১.সাঁই ও ২.স্রস্টা।
৩. তার = ১.ইড়া, ২.পিঙ্গলা ও ৩.সুষুম্না ।
৪. চারচন্দ্র = ১.সরলচন্দ্র ২.গরলচন্দ্র ৩.রোহিণীচন্দ্র ও ৪.মোহিনীচন্দ্র।
৫. পঞ্চবাণ = ১.মোহন, ২.মাদন, ৩.তাপন, ৪.শোষণ ও ৫.স্তম্ভন।
৬. ছয়রিপু = ১.কাম, ২.ক্রোধ, ৩.লোভ, ৪.মোহ, ৫.মদ ও ৬.মাৎসর্য্য।
৭. সপ্তকর্ম = ১.দর্শন, ২.শ্রবণ, ৩.শ্বসন, ৪.বলন, ৫.মৌনতা, ৬.বিজ্ঞতা ও ৭.নিষ্কামিতা।
৮. অঙ্গ = ১.নিরীক্ষ, ২.নয়ন, ৩.মন, ৪.জ্ঞান, ৫.হস্ত, ৬.পদ, ৭.শ্বাস ও শিশ্ন।
৯. নয়দ্বার = ১.দর্শনদ্বার, ২.কর্ণদ্বার, ৩.শ্বাসদ্বার, ৪.অন্নদ্বার, ৫.মলদ্বার, ৬.জলদ্বার, ৭.শুক্রদ্বার, ৮.রজদ্বার ও ৯.সাঁইদ্বার।
১০. ইন্দ্র = ১.চক্ষু, ২.কর্ণ, ৩.নাসিকা, ৪.জিহবা, ৫.ত্বক, ৬.বাক্, ৭.পাণি, ৮.পাদ, ৯.পায়ু ও ১০.উপস্থ।
এগুলোকে সংক্ষেপে এরকম বলা হয়- ১.একনিরীক্ষ, ২.দুইফল, ৩.তিনতার, ৪.চারচন্দ্র, ৫.পঞ্চবাণ, ৬.ছয়রিপু, ৭.সাতকর্ম, ৮.অষ্টাঙ্গ, ৯.নয়দ্বার, ১০.দশইন্দ্র, ১১.এগাররুদ্র, ১২.বারোনেতা, ১৩.তেরনদী, ১৪.চৌদ্দপোয়া, ১৫.পনেরচল, ১৬.ষোলকলা, ১৭.আঠারোধাম, ১৮.ঊনিশরক্ষী, ১৯.বিশাঙুল, ২০.একুশদিন, ২১.তেইশজোড়া, ২২.চব্বিশপক্ষ।
এসব মূলক সংখ্যা কে আত্মতাত্ত্বিক রুপকাররা রুপক ভাবে প্রকাশ করে থাকেন, যেমন- ছয় রিপু কে বলেনঃ ছয় ডাকাত, ছয় মাসের কন্যা, ছয়জন মাঝি, ছয় চোর, ছয় পাগল, ছয় দস্যু ইত্যাদি, আত্মতত্ত্বের রূপক বানীতে যতরকম ছয় থাকবে, বুঝতে হবে এখানে মানব মনের ছয় রিপুর কথা বলা হচ্ছে। ঠিক তেমনি ভাবে নয়মাসের গর্ভ মানে ৯ টা দ্বার উন্মুক্ত হওয়া, এগারমাস হলো এগার রুদ্র, আর তিন সন্তান হলো- লাল সাদা ও কালো ধারা। চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগলে অর্থাৎ যৌবন উদয় হলেই নারী দেহে সাদা কালো ও লাল ধারা চালু হয়। অন্যদিকে দেহতত্বে- ১.শুক্র, ২.সুধা ও ৩.মধু- এ তিনটি ধারাকেও তিনটি সন্তান বলা হয়। যা উৎপন্ন হয় চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরেই, অর্থাৎ যৌবনপ্রাপ্ত হলেই।
ঘর আছে দুয়ার নাই,
মানুষ আছে তার কথা নাই,
কেবা তার আহার জোগায়,
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি।
এখানে ঘর বলতে মাতৃ জঠর বা গর্ভাশয় বুঝানো হচ্ছে, মায়ের গর্ভ এরকম একটা ঘর যেই ঘরে দুয়ার নাই, জানালা নাই, সেখানে মানুষ আছে কিন্তু সেই মানুষের কোন বাক্য নাই। সেই ঘরে দিন নাই রাত নাই, নাই আহার বিহার বা সন্ধ্যাবাতির ব্যবস্থা। চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরে যখন একজন মানুষ পুনর্জন্মে যায়- তখনি এই অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
লালন সাঁইজি ভেবে বলে,
মাকে ছুঁলে মরে ছেলে,
এ তিন কথার অর্থ নইলে,
তার হয় না ফকিরি।
আমরা প্রথমের জেনেছি- চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরপরই ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম হয়। আত্মদর্শনে দেহকে ঝি এবং শুক্রকে মা ধরা হয়। দেহের মধ্যে শুক্রর সৃষ্টি হওয়াকে রূপকার্থে ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম বলা হয়। শুক্রই মা এবং দেহই যে ঝি তার প্রমাণস্বরূপ সাঁইজির উপস্থাপন- “লালন ফকির ভেবে বলে, মাকে ছুঁলে মরে ছেলে, এসব কথার অর্থ নইলে, তার হয় না ফকিরি”। এখানে ছেলে হলো শিশ্ন এবং মা হলো শুক্র। অর্থাৎ দেহরূপ ঝিয়ের ক্ষেত্রেও যেরূপ মা হলো ‘শুক্র’ তদ্রপ শিশ্নরূপ ছেলের ক্ষেত্রেও মা হলো ‘শুক্র’। অতএব এবার সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় কবির মনোকল্পে নির্মিত ঝি হলো অবশ্যই নরদেহ এবং মা হলো অবশ্যই শুক্র। শিশ্নরুপ ছেলে যখন মা রুপ শুক্র কে স্পর্শ করে তখনি তার মৃত্যু ঘটে, শুক্রপাত মানে মৃত্যু। আত্মদর্শনে প্রয়াণ হচ্ছে জীবের দেহাবসান, অন্যদিকে মৃত্যু মানেই কামযজ্ঞে গিয়ে শুক্রপাতরুপ মৃত্যুবরণ করা। যখন একজন মানুষ শুক্রপাত বন্ধ করে লাল সাদা ও কালো ধারার সন্ধান পাবে, বন্ধ করতে পারবে নিজের জন্ম মৃত্যু, সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে তিন কথার অর্থ সেই ফকির হবে, সেই সাধক হবে।
মহাত্মা লালন সাঁইজি তাঁর অমৃত বানীতে মানবের পূর্ণ জীবন বিধান রেখে গেছেন, ছন্দোবদ্ধ গানের আড়ালে বর্ণনা করে গেছেন অপূর্ব এক মানবদর্শন। যে দর্শন সর্বকালে সর্বযুগে সকল মানুষের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য। সাঁইজি বারবার তার বানীতে নিজেকে চিনে নেওয়ার কথা বলেছেন, বলেছেন- দেহ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নের কথা। আত্মতত্ত্ব প্রেমী সকল সাধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন, চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার পরপরই প্রত্যেকের উচিৎ আত্মদর্শন জ্ঞান লাভ করা। ধর্ম জাতপাত যার যার, আত্মদর্শন সবার।
তথ্যসূত্রঃ
লালিত লালন (১ম খণ্ড)
সংকলন সম্পাদনা ও গবেষণাঃ কালের লিখন
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি-
@ কালের লিখন- কবি, লেখক, গীতিকার, পুঁথিকার, শিশু সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক, আত্মতাত্ত্বিক দার্শনিক, লোকসাহিত্য ও লালন গবেষক।
Thanks. Very tough effort. Want to know more and more clearly.
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
উত্তরমুছুন১১ রুদ্র গুলো কী
উত্তরমুছুনঅশেষ কৃপা।
উত্তরমুছুনঅশেষ কৃপা।
উত্তরমুছুনচমৎকার লিখা।। মোহিত হলাম
উত্তরমুছুনখুবই অসাধারণ, তবে বোঝা বড়ো দায়।
উত্তরমুছুনখুবই অসাধারণ, তবে বোঝা বড়ো দায়।
উত্তরমুছুনsada, lal kaalo holo satwa,rajo aar tamo goon.
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনজয় গুরু
উত্তরমুছুনজয় গুরু, দয়াল দয়া করে বলবেন তের নদী কি কি?
উত্তরমুছুনমুগ্ধ।
উত্তরমুছুনthanks
উত্তরমুছুনআলোচিত গানটির একটি উত্তর গান রয়েছে যা অনেকেই জানেন না।
উত্তরমুছুনধাঁধা
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম
তাকে তোমরা বলবে কি?
ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হলো
এগার মাসে তিনটি সন্তান
কোনটা করবে ফকিরি?
ঘর আছে তার দুয়ার নাই
মানুষ আছে তার বাক্য নাই
কেবা তাহার আহার যোগায়
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি?
লালন সাঁই ফকির বলে
মাকে ছুলে মরে ছেলে
এই তিন কথার অর্থ নইলে
তার হবেনা ফকিরি।
----
উত্তর
চাঁদেতে হতে হয় চাঁদের সৃষ্টি
চাঁদেতে হয় চাঁদময়।।
সৃষ্টিতত্ত্ব দ্বাপরলীলা আমি শুনতে পাই।
জল থেকে হয় মাটির সৃষ্টি
জ্বাল দিলে জল হয় কি মাটি
বুঝে দেখ এই কথাটি
ঝিয়ের পেটে মা জন্মায়।।
এক মেয়ের নাম কলাবতী
নয় মাসে হয় গর্ভবতী
এগারো মাসে সন্তান তিনটি
মেজোটা তার ফকির হয়।।
ডিমের ভিতর থাকলে ছানা
ডাকলে পরে কথা কয় না
সেথায় সাঁইয়ের আনাগোনা
দিবারাত্রি আহার যোগায়।।
মাকে ছুঁলে পুত্রের মরণ
জীবগনে তাই করে ধারণ
ভেবে বলে ফকির লালন
হাটে হাড়ি ভাঙ্গবার নয়।।
এখানে দেখা যাচ্ছে লালন একটি ধাঁধার উত্তর দেননি এবং তা নিয়ে রহস্য করেছেন, ‘হাটে হাড়ি ভাঙ্গবার নয়’। এখানে ‘মাকে ছুঁলে পুত্রের মরণ, জীবগনে তাই করে ধারণ’ কথাটিতে মনে হয় তা ‘লবন’ (পানি থেকে লবন হয় এবং লবনকে পানি ছুলে তা নিঃশেষ হয় বা মরে যায়)। ‘মেজোটা তার ফকির হয়’ বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে দেই। কলা গাছের তিনটি চারা গজায় (এগারো মাসে সন্তান তিনটি), তাদের মধ্য থেকে মাঝের চারাগাছটি কেটে ফেলা হয় অন্য দুটি চারা থেকে ভালো ফলনের স্বার্থে।
আরো একটু ভালো ভাবে বিশ্লেষণ করলে ভালো হতো।।
মুছুনবেশ।
মুছুনজয় গুরুর জ। এই গানটির ব্যাখা করার জন্য অন্তরের অন্তস্থ থেকে বিনম্র ভক্তি রইলো 🌼🌼🌼
উত্তরমুছুনলেখক কে জানতেপারলাম নাতো
উত্তরমুছুনচমৎকার গ্রহণযোগ্য তথ্য উপাত্ত
উত্তরমুছুনজয় গুরু
উত্তরমুছুনভাই এত কঠিন কথা বুঝতে না পেরে আমার মাথা ঘুরছে🤯🤯🤯
উত্তরমুছুনউলটা পালটা মনে হলো সাঁইজির কালাম মনগরা মন্তব্য না করাই ভাল
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর ব্যাখ্যা
উত্তরমুছুনআজরাতে বউ আমাকে বাবা বলেছে গানের অর্থ কি
উত্তরমুছুন